মনু নদের পানি কমেছে, বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন বন্যার্তরা
মনু নদে আগের মতো প্রবল স্রোত নেই। পানিও কমে গেছে। বাঁধের ওপর খোলা স্থানে কিছুদূর পরপর কাঠের আসবাব ও গৃহস্থালির নানা সামগ্রী স্তূপ করে রাখা। কেউ কেউ টিন-বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ পলিথিন দিয়ে মালামাল ঢেকে রেখেছেন। নদের বাঁধ ভেঙে পানির তোড়ে কারও আধা পাকা ঘর বা কারও কাঁচা ঘর ভেসে গেছে। কারও ঘর ধসে পড়েছে। এ অবস্থায় বাঁধই এখন তাঁদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে।
এর আগে প্রবল বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ২০ ও ২১ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম হাজীপুর ও মিয়ারপাড়া গ্রামে মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। এ সময় ভাঙনকবলিত স্থান দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকে অন্তত ২১টি গ্রাম প্লাবিত হয়।
সরেজমিন আজ শনিবার দুপুরে বন্যাকবলিত মিয়ারপাড়া এলাকায় দেখা যায়, মনু নদে পানি বেশ কমে গেছে। বন্যাকবলিত স্থান দিয়ে একটু একটু করে পানি ভেতরে প্রবেশ করছে। বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর বাড়িঘর থেকে পানি নামলেও রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি থেকে এখনো নামেনি। ব্রাহ্মণবাজার-শমসেরনগর সড়কের টিলাগাঁও বাজার থেকে পানি নেমে গেছে। তবে ব্রাহ্মণবাজারের কাছে কিছু স্থানে সড়ক থেকে এখনো পানি নামেনি।
মিয়ারপাড়ায় বাঁধের ভাঙনকবলিত স্থানের একেবারে পাশঘেঁষা সুজন মিয়াদের বাড়ি। ছয় ভাই ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন তিনি। পাশাপাশি তিনটি আধা পাকা ঘর ছিল। দুটি ভেসে গেছে। বাঁধের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ দেখে আগেই বাড়ির নারী ও শিশুদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেন। আশপাশের লোকজনের সহায়তায় ঘর থেকে কিছু মালামাল বের করে বাঁধের ওপর রাখেন। একপর্যায়ে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। আর কিছুই বের করা সম্ভব হয়নি। সুজন দুই আত্মীয়কে নিয়ে বাঁধের ওপর বাঁশের খুঁটি পুঁতে অস্থায়ী ঘর তৈরি করছিলেন।
সুজন বলেন, ‘ঘরে ধান, চাল, সোনা, টেকা ছিল। বাইর করতাম পারছি না। সব ভাসাই নিয়া গেছে। যে ঘর টিকে আছে, এই টারও অবস্থা ভালো নায়। বান্ধোত (বাঁধ) থাকা ছাড়া আর উপায় নাই।’ শুধু সুজন নয়, বন্যায় বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এলাকার অন্তত ৪০টি পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন।
মিয়ারপাড়ার দিনমজুর নিঝুম আলীরও আধা পাকা ঘর ধসে গেছে। নিঝুম কান্না করতে করতে বলেন, ‘ধারদেনা করি চাইর-পাঁচ বছর আগে ঘরটা বানাইছিলাম। আমার কিচ্ছু রইল না। স্রোতে ঘরটা ভাঙি গেছে।’ শাহাজাদপুরের ছমেদ আলী বলেন, ‘ধান বাঁচানির লাগি জীবন বাজি রাখি ঘর ছাড়ছি না। ধান ভাসি গেলে খাইয়া-বাঁচি থাকমু কিলা। পরিবারর সবাইরে আগেই সরাই দিছিলাম। ঘর থাকি পানি উঠানে নামছে। বেড়া ভাঙছে। ঘরর ভেতরে হাঁটুসমান কাদা। না শুকাইলে ঢোকা যাইত নায়।’
বন্যার্ত মানুষের পাশে অনেকে
টিলাগাঁওয়ের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় সরকারের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকে।
পাশের রাউৎগাঁও ইউনিয়নের মনরাজ গ্রামের বাসিন্দা ছুরুক আলীর বোনের বাড়ি মিয়ারপাড়ায়। পানিবন্দী হওয়ার খবর পেয়ে বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান। তবে বোনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন এখনো পানিবন্দী। ছুরুক বলেন, ‘গতকাল শুক্রবার বাড়ি থেকে ভুনা খিচুড়ি রান্না করে এনে দুর্গত ১০০ মানুষকে দিয়েছি। এক হাজারটি মোমবাতি কিনেও বিতরণ করেছি।’
‘গণিপুর ইসলামী যুব সংঘ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা মিয়ারপাড়ায় দুর্গত মানুষের মধ্যে খাবারের প্যাকেট ও পানীয় জলের বোতল বিতরণ করেন। শ্রীমঙ্গলের কয়েকজন তরুণ বন্যার্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ান। তাজপুর এলাকায় তাঁরা ত্রাণ বিতরণ করেন।
টিলাগাঁও বাজারে সেনাবাহিনীর একটি দল স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবীর সহযোগিতায় দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে।
দ্রুত বাঁধ মেরামতের দাবি
টিলাগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মালিক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া ও চকসালন এলাকায় মনু নদের বাঁধে বড় দুটি ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। আরও কয়েকটি স্থান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এসব স্থান মেরামত করতে হবে। নইলে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এসব স্থান দিয়ে পানি ঢুকে আরও ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। গতকাল মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক বন্যাকবলিত বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করতে যান। এ সময় জেলা প্রশাসকের কাছেও তিনি এ দাবি জানান।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল মুঠোফোনে বলেন, এখনো অনেক স্থানে বন্যার পানি পুরোপুরি নামেনি। নামলে স্থানগুলো জরিপ করে দ্রুত মেরামতকাজ শুরু করা হবে। যেখানে পানি নেমে গেছে, সেসব স্থানে মেরামতকাজ চলছে।