‘আমাগোর মতো গরিব মাইনষ্যের টিকা থাকাই মুশকিল’

বাজারে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। গতকাল দুপুরে গাজীপুরের জয়দেবপুর কাঁচাবাজারেছবি: আল-আমিন

গাজীপুর নগরের শিববাড়ী মোড়ে একটি অস্থায়ী দোকানে চা বিক্রি করেন ষাটোর্ধ্ব আমান আলী। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন বিলাশপুরে ভাড়া বাসায়। সামান্য আয়ে কোনোরকমে সংসার চলে তাঁর। কখনো কখনো হাত পাততে হয় মানুষের কাছে, করতে হয় ধারদেনা।

আমান আলীর টেনেটুনে চলা এই জীবনে নতুন অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে নিত্যপণ্যের চড়া দাম। বাজারে প্রায় সব সবজির কেজি ১০০ টাকার কাছাকাছি। মাছ-মাংসের দাম আগে থেকেই আকাশচুম্বী। বাজারে গেলেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে তাঁর। কখনো কখনো বাজার থেকে ফিরছেন খালি হাতে।

গতকাল সোমবার দুপুরে আমান আলীর সঙ্গে দেখা হয় জয়দেবপুর কাঁচাবাজারে। বাজারের প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকসংলগ্ন একটি সবজির দোকানে বেগুনের দাম নিয়ে এক দোকানির সঙ্গে তর্কে জড়ান তিনি। একপর্যায়ে বেগুন না কিনেই ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি।

আমান আলী এ প্রতিবেদকের কাছে বলেন, ‘মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১ কেজি বেগুন (লম্বা) কিনছি ৬০ ট্যাকা দিয়া। আইজক্যা আইস্যা শুনি, দাম হইয়্যা গেছে ১২০ ট্যাকা। আমি অনুরোধ করে কইলাম, আমি গরিব মানুষ, এত ট্যাকা নাই, কিছু ট্যাকা কম রাখেন। কিন্তু দোকানদার কোনো কথাই হুনল না। হেললাইগ্যা রাগ কইর‍্যা দোকানদারের লগে ঝগড়া করছি। এই বাজারে আমাগোর মতো গরিব মাইনষ্যের টিকা থাকাই মুশকিল।’

শুধু আমান আলী নন, নগরের বিভিন্ন বাজারে নিম্ন আয়ের মানুষের হাহুতাশ দেখা যাচ্ছে। চাল, ডাল, তেলসহ বেড়েছে প্রায় প্রতিটি সবজির দাম। মাছ-মাংসের দাম তাঁদের নাগালের বাইরে।

গতকাল জয়দেবপুর কাঁচাবাজারের কয়েকজন সবজি বিক্রেতা জানান, এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি শসার দাম ছিল ৫০ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়। লম্বা বেগুন ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা, গোল বেগুন ১০০ থেকে বেড়ে ২৩০ টাকা, টমেটো ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫০ টাকা, কাঁচা মরিচ ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকা, ধনেপাতা ১২০ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা, করলা ৬০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা এবং বরবটি ৭০ থেকে বেড়ে ১০০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া আলু বস্তাপ্রতি (৬৫ কেজি) ৪০০ এবং পেঁয়াজ বস্তাপ্রতি ৫০০ টাকা বেড়েছে।
সবজি ব্যবসায়ীরা বলেন, সাধারণত শীতকালে সবজির দাম কমে। এর বাইরে বছরের অন্যান্য সময় প্রায় সব সবজির দাম ওঠানামা করে। কিন্তু এবার ঠিক কী কারণে সবজির দাম বেড়েছে, তা তাঁরা সঠিকভাবে জানেন না। তাঁদের দাবি, আড়ত থেকে বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে, তাই বিক্রিও করছেন বেশি দামে।

সবজি বিক্রেতা মো. হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খুচরা বিক্রেতা। আড়ত থেকে সবজি এনে বাজারে বিক্রি করি। এখন কোনো কারণে আড়তে দাম বেশি রাখলে আমাদের কিছু করার থাকে না।’

গত ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজারে প্রতি ড্রাম (১৮৫ কেজি) খোলা তেলের (সুপার) দাম ছিল ২৬ হাজার ২০০ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার টাকায়।

একইভাবে দাম বেড়েছে চাল, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজারে প্রতি ড্রাম (১৮৫ কেজি) খোলা তেলের (সুপার) দাম ছিল ২৬ হাজার ২০০ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার টাকায়। খোলা তেল (পাম্প) প্রতি ড্রাম ২৫ হাজার ৬০০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৩০০ টাকায় এবং সয়াবিন তেল প্রতি ড্রাম ২৭ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩১ হাজার ৪০০ টাকা। এর বাইরে চালের দাম কেজিপ্রতি ২–৩ টাকা বেড়েছে। মুগ ডাল ১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৮ টাকায়। আর ডিম গত তিন দিনের তুলনায় হালিতে বেড়েছে তিন টাকা।

মুদিদোকানি মো. ইউসুফ বলেন, ‘তেলের দাম এভাবে হুট করে বাড়তে আমি আগে কখনো দেখি নাই। তেলের দাম শুনেই ক্রেতারা চমকে উঠছেন।’

তবে ক্রেতাদের দাবি, বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ান ব্যবসায়ীরা। সবজির সরবরাহ কম, তাঁদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। ঠিকমতো বাজার তদারকি করলে এমন সমস্যা হতো না বলে দাবি তাঁদের।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন মুঠোফোনে বলেন, ‘বাজার মনিটরিং এর ব্যাপারে ইতিমধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি।’