‘ছেলেরে ফোন দিই কিন্তু ফোন ধরে না। এমুন তো কোনো দিন হয় নাই। মনটা অস্থির লাগতাছিল। সারা রাত দুই চোখ বোঝে নাই। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি (পায়চারী) করছি। বেইন্নালা (ভোর) বরিশালে রওনা দিছি।’
রোববার দুপুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে এভাবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা বলছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মুকুল আহমেদের বাবা সাফিজ উদ্দীন (৬৫)। ছেলেকে ফোনে না পেয়ে নরসিংদী থেকে বরিশালে ছুটে এসেছেন তিনি। তখনো জানতেন না, নির্যাতনের শিকার হয়ে ছেলে হাসপাতালের শয্যায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। পরে জানতে পারেন, নির্যাতনকারীরা ছেলের মুঠোফোনটিও কেড়ে নিয়েছিল।
ছলছল চোখে সফিজ উদ্দীন বলেন, ‘আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই, ছেলেটারে তারা এমুনভাবে মারবে!’ একপর্যায়ে গলা ধরে আসে সফিজ উদ্দিনের। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘কী দোষ করছে আমার ছেলে?’ তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। অনেকগুলা পোলাপাইন। ছয় মেয়ে, দুই ছেলে। পাঁচ মেয়েকে বিয়ে দিছি। ছোট মেয়েটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এই দুইটা ছেলে-মেয়ে নিজেগোর ইচ্ছায়ই অনেক কষ্টে এই পর্যন্ত আসছে। আমি তো ওগোর খরচও দিতে পারি নাই। কাঠমিস্ত্রির জোগালি (সহকারী) দিয়া কত আর পাই। সংসার চালামু না পড়াইমু। মুকুল টিউশনি করে নিজে পড়ে, বোনরেও খরচা চালায়। সেই ছেলেটারেও অহন হাত ভাইঙা দিছে।’
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ইউনিটটে চিকিৎসাধীন মুকুল আজ রোববার দুপুরেও স্বাভাবিক হতে পারেননি। সেই রাতের নির্যাতনের আতঙ্ক এখনো তাঁর চোখেমুখে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের ৪০১৯ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে রাতভর নির্যাতন করে তাঁর বাঁ হাত ভেঙে দেওয়া হয়। মুকুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
লিখিত অভিযোগ, কক্ষ সিলগালা
নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মুকুল আহমেদ। বিশ্বদ্যিালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষের কাছে পৃথকভাবে তিনি এ অভিযোগ করেন। লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর নির্যাতনের ঘটনা ঘটা কক্ষটি সিলগালা করেছে হল কর্তৃপক্ষ। হলের চতুর্থ তলার ওই কক্ষটি নির্যাতনকারী কথিত ছাত্রলীগ নেতারা অবৈধভাবে দখল করেছিলেন। কক্ষটি অঘোষিত টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু হলের প্রাধ্যক্ষ মো. আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর অভিযোগের পর তাঁরা কক্ষটি তালাবদ্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছেন। অভিযোগপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির কাছে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, যে কক্ষে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সেটি অবৈধ দখলে ছিল।
এর আগে শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম, হল প্রাধ্যক্ষ মো. আরিফ হোসেন ও ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান তানভীর কায়সার হাসপাতালের অর্থোপেডিক ইউনিটে চিকিৎসাধীন মুকুলের খোঁজখবর নেন। তাঁরা ঘটনার বর্ণনা শোনেন এবং এ ব্যাপারে উপাচার্য, প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান বরাবর পৃথক লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। বিষয়টি তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন তাঁরা। পরে আজ দুপুরে বাবা সাফিজ উদ্দীনের মাধ্যমে লিখিত অভিযোগটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান মুকুল।
প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মুকুলের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। তাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। একই সঙ্গে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য কিছু নগদ অর্থসহায়তা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও সহায়তা দেওয়া হবে। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সেটিও করা হবে। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। অভিযোগ দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করে দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’
মুকুল আহমেদের অভিযোগ, ইংরেজি বিভাগের অষ্টম ব্যাচের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তানজিদ মঞ্জু ও সিহাব উদ্দিন এই নির্যাতন চালিয়েছেন। তাঁরা মুকুলকে বঙ্গবন্ধু হলের ৪০১৯ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে বেদম মারধর করেন।
তবে তানজিদ মঞ্জু দাবি করেন, ‘ওই ছেলে (মুকুল) নীরবে শিবির করে। আমার ছোট ভাইদের বলেছিলাম, ওকে ডেকে নিয়ে সতর্ক করার জন্য। আমার ছোট ভাইয়েরা ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে সতর্ক করেছে মাত্র। মারধর করেনি। কোথাও পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গেছে। এখন আমাকে ফাঁসানোর জন্য সেটা ব্যবহার করছে।’
যেভাবে, যে কারণে নির্যাতন
মুকুলের ভাষ্য, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টিউশনি করে হলে ফিরছিলেন তিনি। পথে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা হয়। মুকুল তাঁদের কাছে রাতে ক্যাম্পাসে যাওয়ার কারণ জানতে চান। শিক্ষার্থীরা তাঁকে জানান, দশম ব্যাচের (দ্বিতীয় বর্ষ) বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধু হলে ডেকেছেন।
পরে হলে ফিরে মুকুল দশম ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি বার্তা লেখেন, ‘আমাদের ব্যাচের নামে ছোট ভাইদের ডাকা হয়েছে, অথচ আমরা জানি না। আগেও এভাবে ডেকে র্যাগিং করা হয়েছে অনেককে। তখন বিভাগের শিক্ষকদের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। এখন আবার ডাকা হয়েছে। আমরা জানি না। এটা বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই না।’
এর কিছুক্ষণের মধ্যে তানজিদ মঞ্জু মুকুলকে ফোন করে শের–ই–বাংলা হলের দিকে যেতে বলেন। রাত আটটার দিকে বঙ্গবন্ধু হলের চতুর্থ তলায় নামতেই তানজিদের সঙ্গে দেখা হয় মুকুলের এবং সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় চতুর্থ তলার ৪০১৮ নম্বর কক্ষে।
তানজীদ ও তাঁর সহযোগী সিহাব তাঁকে কিলঘুষি, লাথি এবং একপর্যায়ে জিআই পাইপ, ভাঙা চেয়ারের কাঠের হাতল দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেন। তিনি জ্ঞান হারালে ওই কক্ষে তাঁকে ফেলে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে যান তাঁরা। গত শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
আতঙ্কে সাধারণ শিক্ষার্থীরা
নির্যাতনের ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হলের অন্তত সাতজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধু হলের চতুর্থ তলার ৪০১৯ নম্বর কক্ষটি অঘোষিত টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করেন তানজিদ মঞ্জু, সিহাব উদ্দিন ও তাঁদের সহযোগীরা। তাঁদের আনুগত্য স্বীকার না করলে কেউ হলে থাকতে পারে না। তাঁদের কাছে শিক্ষার্থীরা জিম্মি। নির্যাতনের ঘটনার পর তাঁরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন।
প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম বলেন, এত দিন হলে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছিল। কিন্তু মুকুল একেবারেই নিরীহ এক শিক্ষার্থী। তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। এ ঘটনায় ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি। কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা কমিটি এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’