পাহাড়, ঝরনা, সমুদ্র—সেরা পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার সবকিছু আছে মিরসরাইয়ে
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার পুরো পূর্ব পাশজুড়ে আছে সুউচ্চ পাহাড়। সে পাহাড়ের বুক চিরে কলকলিয়ে ঝরছে ঝরনা। পাহাড়ের পাদদেশেই আছে চোখজুড়ানো হ্রদ। এ উপজেলার পুরো উত্তর পাশটা যেমন ঘিরে রেখেছে টলটলে জলভরা ফেনী নদী, তেমনি পশ্চিম পাশে প্রায় ২০ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে সমুদ্র। প্রকৃতির অকৃপণ দান বন, পাহাড়, ঝরনা, নদী, সমুদ্র ও হ্রদের এমন সম্মিলন দেশে আর কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে। এই কারণে মিরসরাইকে বলা হচ্ছে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় পর্যটন স্থান।
পাহাড় আর ঝরনার মিতালি
মিরসরাই উপজেলার পুরো পূর্ব পাশ পাহাড়ে ঘেরা। এখানকার পাহাড়গুলোয় আছে ঘন সবুজ চিরহরিৎ বন। হরেক রকম গাছ, লতা-গুল্ম আর নানা জাতের পশুপাখি মিলে এ বন যেন প্রাণপ্রকৃতির জাদুঘর। এসব পাহাড়ের বুক চিরে কলকলিয়ে ঝরছে চোখধাঁধানো বেশ কিছু ঝরনা। ঝরনাগুলোর মধ্যে খৈয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, সোনাইছড়ি, বোয়ালিয়া, বাওয়াছড়া ও মহামায়া বেশ নজরকাড়া। এ ছাড়া ঝুঁকির কারণে বন বিভাগের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা মেলকুম ট্রেইলটি এখনো পর্যটকদের আরেক বড় আকর্ষণের জায়গা।
স্বচ্ছ জলের হ্রদ
এ উপজেলায় ঘুরতে এলে দেখা মিলবে মহামায়া, সোনাইছড়া ও বাওয়াছড়ার মতো স্বচ্ছ জলের মনভোলানো হ্রদের। এ হ্রদগুলোর মধ্যে মহামায়া আবার দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ। এ হ্রদে এসে নৌকায় ঘুরে নানা জলজ পাখি দেখাসহ শীতল জলে গা এলিয়ে দেওয়ার যে প্রশান্তি, তা আর কিছুতে মেলে না। এসবের সঙ্গে হ্রদে ইচ্ছেমতো কায়াকিং করার সুযোগ ভ্রমণে বাড়তি আমেজ তৈরি করে।
ফেনী নদীর অনন্য রূপ
মিরসরাইয়ে ঘুরতে এলে ফেনী নদীর মুহুরি সেচ প্রকল্প এলাকায় একবার ঢুঁ মারতেই হবে। এখানে নদীটির শেষ প্রান্তে মিশে গেছে সমুদ্রের সঙ্গে। এ নদীতে নৌকায় ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখা যাবে বক, পানকৌড়ি আর মাছরাঙাদের ওড়াউড়ি। বেড়ানো শেষে নদীপাড়ের বেড়িবাঁধের ভাতঘরগুলোয় খাওয়া যায় নদী ও সমুদ্র থেকে তুলে আনা তাজা মাছ আর মহিষের দুধের টাটকা দই আর মুহুরি সেচ প্রকল্পের সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে গায়ে নোনা হাওয়া মাখতে মাখতে গোধূলিবেলায় সূর্যাস্ত দেখার সুখস্মৃতি মনে গেঁথে থাকবে বহুকাল।
ক্লান্তি জুড়াবে সমুদ্রকূলের হাওয়া
মিরসরাই উপজেলার পুরো পশ্চিম দিকটাই সমুদ্রঘেরা। দিনমান পাহাড় ঝরনা আর হ্রদে ঘুরে ক্লান্ত হলে সমুদ্রতীরে এসে বসলে লোনা হাওয়া জুড়াবে মনপ্রাণ। আর চোখের সীমানায় উত্তাল ঢেউয়ের তালে জেলে নৌকার নাচন দেবে চোখের প্রশান্তি। ইচ্ছা করলে এখানকার মাছঘাটগুলোয় ঘুরে ঘুরে দেখা যাবে জেলেজীবনের সুখ-দুঃখ। সব শেষে সৈকতের জলে ভেজা পায়ে বাড়ির পথ ধরলে মনে হবে জীবন সুন্দর আর প্রকৃতির এমন অপার সৌন্দর্য দেখতে এখানে বারবার ফিরে আসতে চাইবে মন।
সম্প্রতি মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনায় কথা হয় ঢাকার বংশাল থেকে আসা একটি পর্যটক দলের এক সদস্যের সঙ্গে। মিরসরাইয়ে ঘুরতে এসে কেমন লাগছে জানতে চাইলে পেশায় স্থপতি ইব্রাহীম আনোয়ার খান নামের ওই পর্যটক বলেন, ‘ঘুরতে আসার জন্য মিরসরাই উপজেলা একটি অসাধারণ জায়গা। বন পাহাড়, ঝরনা, হ্রদ, নদী ও সমুদ্রের এমন সন্নিবেশ দেশের আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। আমরা এরই মধ্যে মহামায়া হ্রদ আর খৈয়াছড়া ঝরনা ঘুরেছি। দুটোর সৌন্দর্যই মনকাড়া। তবে রাতযাপনের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় চাইলেও একবারে এসে এখানকার সব কটি পর্যটন স্পট ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। সরকার এখানে পর্যটনের উন্নয়নে কিছু করেছে বলে মনে হয়নি। থাকা, খাওয়া আর যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা থাকলে এখানে বিশ্বমানের পর্যটনকেন্দ্র তৈরির সব উপাদানই আছে। প্রকৃতি যেন দুই হাত ভরে সব ঢেলে দিয়েছে এখানে।’
পর্যটনের সম্ভাবনা
মিরসরাইয়ে পর্যটনশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উপব্যবস্থাপক (বিপণন) শেখ মেহদি হাসান বলেন, বহুমাত্রিক দর্শনীয় স্থানের কারণে পর্যটনশিল্পে মিরসরাইয়ের পরিচিতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত তরুণ ভিডিও ব্লগাররা মিরসরাইয়ের আশ্চর্য সুন্দর পাহাড়, ঝরনা, হ্রদ, নদী, সাগর উপকূলের ছোট ছোট সৈকত উন্মোচিত করেছেন। এসবের সঙ্গে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পনগর নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ও ধর্মীয় নিদর্শন মিরসরাইকে দিয়েছে অনন্য এক পর্যটন গন্তব্যের মর্যাদা। কিন্তু উপযুক্ত আবাসন, পরিবহন, ভালো গাইড ব্যবস্থা, ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের সংস্থান না থাকায় এখানে বড় পরিসরে পর্যটনের সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে। এসব সুবিধা না থাকায় ইচ্ছা থাকলেও অনেক পর্যটক মিরসরাইমুখী হচ্ছে না।