একটি অসম বন্ধুত্বের গল্প
একজনের নাম আকতার, অন্যজন মিন্টু। ২৫ বছর ধরে তারা একে অপরের সঙ্গ ছাড়েনি। বলা যায় গভীর বন্ধুত্বের বন্ধন তাদের মধ্যে। তবে সম্পর্কটি অসম। দেশ-কাল–সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে এমন অসম বন্ধুত্বের উদাহরণ কম নয়। তবে আকতার ও মিন্টুর বন্ধুত্ব সেসবকেও হার মানাবে। কারণ, আক্তারের প্রাণপ্রিয় বন্ধু মিন্টু একটি বানর।
বানরের খেলা দেখিয়ে ৯ সদস্যের পরিবার চালান ৫০ বছর বয়সী আকতার হোসেন। পেশার খাতিরে ২৫ বছরই তাঁর সঙ্গী হয়ে আছে মিন্টু। মিন্টুই তার রুটিরুজির একমাত্র অবলম্বন। দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী মিন্টুর সঙ্গে আকতার হোসেনের গলায়-গলায় ভাব। আকতারের হাত আর চোখের ইশারাতে নানা খেলা দেখিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে প্রৌঢ় বানরটি। আকতার হোসেনের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বেদেপাড়ায়।
সম্প্রতি জোরারগঞ্জ বেদেপাড়ার একটি চায়ের দোকানের সামনে দেখা হয় আকতার হোসেনের সঙ্গে। তিনি তাঁর পোষা বানর মিন্টুকে পাশে বসিয়ে মাথায় আদর করে দিচ্ছিলেন। আদর পেয়ে বারবার মাথা নোয়াচ্ছিল প্রাণীটি।
আকতার হোসেনের সঙ্গে আড্ডায় উঠে আসে মিন্টুর প্রসঙ্গ। আকতার বলেন, ৩০ বছর ধরে বানরখেলা দেখানোর পেশা তাঁর। এ যাত্রায় টানা ২৫ বছরের সঙ্গী মিন্টু। বাচ্চা বয়স থেকে পোষ মানিয়ে বানরটিকে নানা কসরত শিখিয়েছেন তিনি। মিন্টু এখন তাঁর ইশারায় দুই পক্ষের যুদ্ধ, বরের শ্বশুরবাড়ি যাত্রাসহ নানা খেলা দেখিয়ে দর্শকদের আনন্দ দেয়। দর্শক খুশি হয়ে টাকা দেয় আকতারকে। তবে কিশোর ও যৌবনের চঞ্চল মিন্টু এখন বয়সের ভারে বেশ শান্ত। মাছ-ভাত, নানা সবজি আর তাজা ফল খেতে পছন্দ করে সে।
আকতারকে ছাড়া মিন্টু অচল। দিনের বেশির ভাগ সময় দুজনের একসঙ্গে কাটে বলে জানালেন আকতার। নিজের সুখ-দুঃখের কথাও মিন্টুকে বলেন তিনি। মিন্টু সব শোনে। নানা ভঙ্গি করে প্রতিক্রিয়াও জানায়।
আকতার হোসেন বলেন, মিন্টুকে নিয়ে খেলা দেখাতে গিয়ে এরই মধ্যে দেশের সব জেলা ঘুরেছেন তিনি। একবার বের হলে দু–তিন জেলা ঘুরে কয়েক মাস পর বাড়ি ফেরেন তিনি।
তবে দর্শকেরা এখন আর আগের মতো বানরের খেলা দেখতে চান না বলে দাবি আখতার হোসেনের।
তিনি বলেন, ‘বানরখেলা দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দেওয়াই আমার পেশা। এ কাজ করে চার বছর আগেও দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হতো। এখন মানুষের হাতে টাকা নেই। বানরের কেলা দেখতেও চায় না। তা ছাড়া মুঠোফোন আসায় বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সে কারণে এখন দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব হয় না।
আখতার হোসেন বলেন, ‘তিন মেয়ে, দুই ছেলে, তাদের বউ, আমার স্ত্রী, মারা যাওয়া এক ভাইয়ের স্ত্রীসহ নয়জনের সংসার আমার। এক ছেলে শুধু রিকশা চালিয়ে কিছু সাহায্য করে। এ আয়ে এখন চলা মুশকিল। বানরখেলা দেখানো ছাড়া আর তো কোনো কাজ জানি না। আর মিন্টুকে ছেড়ে যাব, তা তো ভাবতেই পারি না। আমি ছাড়া ওর যে আর কেউ নেই।’
বানর তো বন্য প্রাণী, এটি পোষা বেআইনি, তবু কেন পোষেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আকতার হোসেন হেসে বলেন, ‘এটি আমাদের বাপ–দাদার পেশা। শত বছর বংশ পরম্পরায় বানর খেলা দেখানোই আমাদের জীবিকা। আমরাতো প্রাণীটির কোনো অযত্ন করি না। পরিবারের সদস্য হয়েই থাকে আমাদের সঙ্গে।’
জানতে চাইলে জোরারগঞ্জ বেদেপাড়ার সরদার মো. ইমরান হোসেন বলেন, পাড়ায় ৪০০ বেদে পরিবারে সাড়ে তিন হাজার মানুষের বাস। কয়েক বছর আগেও পাড়ার ২৫০ থেকে ৩০০ জনের ঘরে বানর ছিল। পুরো দেশ ঘুরে বানরখেলা দেখিয়ে সংসার চালাতো তাঁরা। এখন সে সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ জনে নেমে এসেছে। এ পেশায় এখন আয় কম। পাড়ার বাসিন্দা আকতার হোসেন এক বানর দিয়েই ২৫ বছর ধরে খেলা দেখাচ্ছে।
বুড়ো হচ্ছে মিন্টু। তার কিছু হলে আকতার কী করবেন ভাবতে পারেন না। বানরটির সামান্য অসুখ-বিসুখও বিচলিত করে তাকে। মিন্টুই যে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী, বন্ধু। যত দিন পারেন, তাকে আগলে রাখতে চান আকতার হোসেন।