গত দেড় দশকে উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থান করেছে রিমাল। বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলে এই ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বড় ঝড়কেও হার মানিয়েছে। সিডর ও আইলার পর দেশে আঘাত হানা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানে যেখানে বরিশাল বিভাগে সাড়ে ১৭ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, সেখানে রিমালে ক্ষতির শিকার ২২ লাখ ৩৫ হাজার জন।
আর্থিক দিক দিয়েও আম্পানের চেয়ে রিমালের ক্ষয়ক্ষতি বেশি। ২০২০ সালের ২০ মে আঘাত হানা আম্পানে মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছিল ৮৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। রিমালে এই খাতে প্রাথমিক ক্ষতি ২১৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। কৃষি খাতে আম্পানে ১৭ হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার আর্থিক মূল্য ছিল ১০০ কোটি টাকার কম। রিমালে ১৮ হাজার ২০৯ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য আম্পানের ক্ষতির চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
বরিশাল বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শওকত ওসমান গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, এবার কৃষি খাতে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার বড় কারণ ঝড়ের স্থায়িত্ব। পাশাপাশি টানা উঁচু জলোচ্ছ্বাস এবং মুষলধারে টানা বৃষ্টি। এখন এ অঞ্চলে আম, কলা ও ব্যাপকভিত্তিক পান ও সবজি আবাদ হয়। একই সঙ্গে বোরো আবাদ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ জন্য আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।
রিমালে এই বিভাগে ১৫ হাজার ৫৩১টি বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭২ হাজার ১৬৩টি ঘর। আম্পানে বিভাগে প্রায় সাড়ে ৪৯ হাজার বাড়িঘর পুরোপুরি ও আংশিক ক্ষতি হয়। আম্পানের তাণ্ডবে যেখানে পুরো বিভাগে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল, এবারের ঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩।
কেন এবার ক্ষতি বেশি
প্রভাব ও বিস্তারের দিক থেকে রিমালকে ব্যতিক্রমী বলছেন আবহাওয়া ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা। এর আগে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানার পর ৩০ ঘণ্টা ধরে দেশের ভূখণ্ডে প্রভাব ফেলেছিল। গত বছর মোখার প্রভাব ছিল মাত্র ৬ ঘণ্টা। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের প্রভাব ছিল ১৬ ঘণ্টা, ২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব ছিল ১০ ঘণ্টা। আম্পান ছিল ২৮ ঘণ্টা। এবার ঘূর্ণিঝড় রিমাল বাংলাদেশে আঘাত হানার পর মোট ৪০ ঘণ্টা স্থল নিম্নচাপ আকারে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থান করেছে।
আবহাওয়া কার্যালয়ের তথ্যমতে, রিমাল উপকূলে আঘাত হানার সময় এর কেন্দ্রে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠেছিল পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায়, রাত দেড়টায়। তখন ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইছিল। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত দীর্ঘ সময় ভূখণ্ডে অবস্থান এবং উঁচু জোয়ারের সঙ্গে টানা প্রবল বর্ষণের কারণেই ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে। বিশেষ করে মৎস্য ও কৃষি খাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিভাগীয় মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, আম্পানে বিভাগের মৎস্য সম্পদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল, তা সর্বশেষ সিডরের পর আর হয়নি। আম্পানে ৮২ কোটি ৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল মৎস্য খাতে। কিন্তু এবার রিমালে প্রায় তিন গুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে।
মৎস্য বিভাগের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, এবার মৎস্য খাতের ক্ষতি অন্যান্য ঝড়ের তুলনায় অনেক বেশি। এর কারণ ঝড়ের স্থায়িত্ব।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার চর বোয়ালিয়া গ্রামের খামারি দুলাল হাওলাদারের চারটি মাছের ঘেরের মাছ পুরোটাই ভেসে গেছে। পোলট্রি খামারের দুই হাজার মুরগি মরে গেছে। বুধবার দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দুলাল মিয়া বিষণ্ন মনে ঘেরের পাশে বসে আছেন। তিনি বলেন, ‘২০ লাখ টাকা ব্যাংকঋণ এনে এসব খামার করেছিলাম। ঝড়ে অন্তত ১৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এখন কীভাবে ঋণ শোধ করব, জানি না।’
কেন চরিত্র বদলাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়
বরগুনার তালতলী উপজেলায় বঙ্গোপসাগর তীর ঘেঁষে তুলাতলী গ্রাম। এখানকার বাসিন্দা মো. খানজাহান আলী ফকির (৮০) অনেক বড় বড় ঝড় দেখেছেন। তিনি বলেন, ১৯৬১ ও ১৯৬৫ সালের পানি বন্যা, ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড় এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫৫ বছরে অনেক ঝড় দেখেছেন। কিন্তু এবারের ঝড়ের মতো এত দীর্ঘ সময় তিনি কোনো ঘূর্ণিঝড়ের স্থায়িত্ব দেখেননি।
উপকূলে বিভিন্ন দুর্যোগ নিয়ে গবেষণা ও দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল শিক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান হাফিজ আশরাফুল হক। ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্র বদলের কারণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে মার্চ থেকে মে-এই তিন মাসে গড় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা মাসভেদে ২৪০ থেকে ৩৪০ মিলিমিটার। কিন্তু এবার ২০ মিলিমিটারও হয়নি। মূলত এটা শুরু হয়েছিল গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। ফলে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে, তাপপ্রবাহ চরমভাবাপন্ন ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আর তাপ হলো একটি শক্তি, যার বিনাশ হয় না; কিন্তু সে যেকোনো উপায়ে অবমুক্ত হবেই। হতে পারে সেটা ঘূর্ণিঝড়, অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত, জলোচ্ছ্বাস কিংবা সুনামির মতো দুর্যোগ।’
রিমাল ভূভাগে প্রবেশের পর দীর্ঘ সময় শক্তিশালী ছিল উল্লেখ করে হাফিজ আশরাফুল বলেন, ‘বিগত দিনে আমরা দেখেছি, সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পর কিংবা আঘাত হানার আগে বৃষ্টিপাত হয়। এবার তা হয়নি। ফলে শক্তি ক্ষয় না করেই পুরো শক্তি নিয়ে রিমাল ভূভাগে আঘাত হেনেছে। এরপর প্রচুর বৃষ্টি ঝরিয়ে শক্তি ক্ষয় করেছে। ফলে ঝড়টি স্থলভাগে দীর্ঘ সময় স্থায়ী ছিল। এখন থেকে ঝড়গুলোর এ রকম চরিত্র আমরা হয়তো দেখব।’
দুর্যোগ প্রশমন ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার বিষয়ে হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, নদী, জলাধার, বনাঞ্চল, মাটির সুরক্ষার ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া জরুরি। বনাঞ্চল বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন বন সৃজন করা দরকার। ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে উপকূলের বাঁধগুলোর উচ্চতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।