ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা ও পাঁচবারের সংসদ সদস্য আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে বিজয়ী করতে সবই করছে আওয়ামী লীগ। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভক্তি, সব ভুলে এক হয়ে তাঁর পক্ষে নির্বাচনে নেতা-কর্মীরা কাজ করছেন। তবে ভোট গ্রহণের দিন কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় আছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতিই এখন তাঁদের লক্ষ্য।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে দলের দুজন সংসদ সদস্যসহ আশুগঞ্জ ও সরাইল উপজেলার একাধিক জনপ্রতিনিধিকে অনেকটা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে উপকারভোগীদের বাধ্যতামূলকভাবে ভোটকেন্দ্রে হাজির করাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে দলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে দলীয় কোনো প্রার্থী নেই। আবদুস সাত্তারকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা এই ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ। তবে বেশি ভোটার চাইলেও উপস্থিত করানো সম্ভব নয়। বিশ্বাসযোগ্যতার একটা বিষয় আছে। তাই অন্তত ৩৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিত করানোই আমাদের মূল্য লক্ষ্য।’
সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে তাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। বিভিন্ন সময় উপকারভোগীরা সরকারের পক্ষ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নেন। এ ধরনের উপকারভোগীসহ অন্য ভোটাররাও কেন্দ্রে আসবেন। আজ রোববার দুপুরে উপজেলার অরুয়াইলে সভা হওয়ার কথা। সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম উপস্থিত থাকবেন।
এই সভার মাধ্যমে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, তা জানতে চাইলে নাজমুল হোসেন এ বিষয়ে কোনো জবাব দিতে চাননি।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরাইল উপজেলার সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম মিলনায়তনে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার সমর্থনে অনুষ্ঠিত আলোচনা ও পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উপনির্বাচনে জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দায়িত্বকে দুটি ভাগে ভাগ করার কথা জানিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বলেন, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার দায়িত্ব মেম্বার-চেয়ারম্যানদের। কলার ছড়া প্রতীকে (আবদুস সাত্তার) নেওয়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের। যাঁরা সরকারের বিভিন্ন সুবিধা পান, জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ভোটকেন্দ্রে হাজির করাবেন। ইউপি চেয়ারম্যান, তাঁর ইউনিয়নের প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারদের হাজিরের ব্যবস্থা করবেন।
যদিও মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বারবার বলে আসছিলেন, আওয়ামী লীগের এমন দুর্দিন এখনো আসেনি যে এই আসনে অন্য দলের কোনো প্রার্থীকে দিয়ে নির্বাচন করাতে হবে; কারণ এ আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আছেন। ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতারা এ বক্তব্যে অটল ছিলেন। তবে ১৩ জানুয়ারি সকাল থেকে দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে শুরু করে। পরের দিন ১৪ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের নেতৃত্বে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। তিন আওয়ামী লীগ নেতার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর থেকে দলের নেতা-কর্মীরা আবদুস সাত্তারের পক্ষে একত্র হওয়া শুরু করেন।
তবে এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে কোনো আগ্রহ চোখে পড়েনি। সাধারণ ভোটারদের মতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই মূলত মাঠে ছোটাছুটি করছেন। সরাইলের ভোটার মফিজ উদ্দিন বলেন, এই নির্বাচনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আমেজ নেই। প্রার্থীরাও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। সরকার ও আওয়ামী লীগের লোকজন আবদুস সাত্তারের পক্ষেই প্রচারণা চালাচ্ছেন। সবকিছুই তো স্পষ্ট।
আশুগঞ্জের তিনজন ভোটার বলেন, আবদুস সাত্তারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রচারণা দেখা যাচ্ছে না। যা করার সব আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই করছেন। তাই ভোটারদের মধ্যে বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। সাধারণ অনেক ভোটারই হয়তো ভোট দিতে কেন্দ্র যাবেন না বলে ধারণা করছেন তাঁরা।
সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নের বয়স্ক ভাতা পান—এমন এক বৃদ্ধ বলেন, স্থানীয় ইউপি সদস্য তাঁকে নির্বাচনের দিন ভোট দিতে যাওয়ার জন্য বলে গেছেন। ওই বৃদ্ধ বলেন, ‘১ তারিখ কেন্দ্রে যাইবার ল্যাইগ্যা মেম্বার (ইউপি সদস্য) বেডা কইয়্যা গেছে। সরকার ভাতা দিতাছে, তাই সরকার নাকি কইছে ওই দিন গিয়া ভোট দিতাম।’
আজ সকাল ১০টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল মামুন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকলে নির্বাচন জমে না। তাই ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য আমরা মাঠে নেমেছি। আশা করছি, ৫০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত হবেন।’
আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াসহ এখন পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে আছেন আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু আসিফ আহমেদ (মোটর গাড়ি), জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানি (লাঙ্গল) ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম (গোলাপ ফুল)।