ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
জেলেদের টিকে থাকাই দায়
নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সরকার নামমাত্র চাল সহায়তা দিলেও তা অধিকাংশ জেলে পান না। ধারদেনায় জর্জরিত উপকূলের জেলেরা।
মা ইলিশ রক্ষা এবং প্রজনন মৌসুম নির্বিঘ্ন করতে ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আগামীকাল ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের অন্তত পাঁচ লাখ জেলের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। আগের নিষেধাজ্ঞার সময়গুলোতে রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জেলেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিন কাটান। মায়েরা প্রয়োজনীয় খাবার না পাওয়ায় দুগ্ধপোষ্য শিশুরাও দুধের কষ্টে ভোগে।
জেলেদের যাতে দুর্দশায় পড়তে না হয়, সে জন্য সরকার সহায়তা দিচ্ছে। যদিও এটা অপ্রতুল, তবে প্রতিবছরই সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সহায়তার বাইরেও সরকার বিকল্প জীবিকায়নের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে ভাবছে।
জেলেরা বলছেন, বছরজুড়ে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সরকার নামমাত্র চাল সহায়তা দিলেও তা অধিকাংশ জেলে পান না। অনেকে জেলে নন, তাঁরাও এ সহায়তা পাওয়ায় প্রকৃত জেলেরা বঞ্চিত হন। এ নিষেধাজ্ঞার জাঁতাকলে তাই ধারদেনায় বছর বছর জর্জরিত উপকূলের জেলেরা।
বরিশাল সদরের লাহারহাট এলাকার সমুদ্রগামী জেলে আবুল হোসেন মোল্লা তাঁর দুর্দশার কথা বলছিলেন প্রথম আলোকে। কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলা ধরে আসে। বলেন, গত দুই বছরে নিষেধাজ্ঞা পালন করতে গিয়ে তিনি ১২ লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। পরিবার নিয়ে এখন চরম দুর্দশার মধ্যে আছেন। মাছ ধরে যে টাকা আয় করেন, তা দিয়ে ঋণ শোধ করে হাতে কিছু থাকে না। ফলে দুর্দশা তাঁর পিছু ছাড়ছে না।
বরগুনা সদরের মাছখালী গ্রামের আরেক জেলে মো. ছগির হোসেন (৫০) বলেন, ‘নদী ও সাগরে নিষেধাজ্ঞার চাপে মোগো জীবনডা চ্যাপটা অইয়্যা গ্যাছে। কষ্টের কথা কইতেও পারি না, সইতেও পারি না। ঘরে পাঁচজন খাওনদার। সরকার যে চাউল দেয়, হ্যাতে ১০ দিনের খোরাকিও (খাবার সংস্থান) অয় না। হ্যারপর বাজার-সওদা, পরিবারের খরচ তো আছেই। নিষেধাজ্ঞায় পড়লে পোলাপানের মোহের দিক চাইতে পারি না। ভাত আর আলুভর্তা এই অইলো মোগো খাওন। তা–ও প্যাট ভইর্যা খাইতে দেতে পারি না।’
নিষেধাজ্ঞার সময় উপকূলের জেলেদের এমন দুর্দশার একটি চিত্র উঠে এসেছে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ও কোস্ট ফাউন্ডেশন—এ তিন প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত একটি গবেষণা চালায়। গত ২০ সেপ্টেম্বর এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। গবেষণার জরিপে বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়ন ও কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের ৮ হাজার ৬৪৪টি পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব পরিবারের মোট সদস্যসংখ্যা ৪২ হাজার ৮৯৬।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, ৮০ শতাংশ পরিবারই একজনমাত্র উপার্জনকারীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এসব পরিবারের মোট ১০ হাজার ৮২ জন মৎস্যকেন্দ্রিক পেশায় জড়িত। মৎস্যশ্রমিক পরিবারগুলোর প্রায় সবার প্রধান পেশা মৎস্য আহরণ। জরিপে অংশ নেওয়া মৎস্যশ্রমিকদের মধ্যে দেখা যায়, সাড়ে ৪২ শতাংশ জেলে কার্ডধারী। তবে এলাকাভেদে এ সংখ্যায় ভিন্নতা রয়েছে। যেমন পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নে সাড়ে ৬৬ শতাংশ জেলে কার্ডধারী হলেও কুতুবজোম ইউনিয়নে তা ৩০ শতাংশ।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্যশ্রমিকদের ৪৫ শতাংশ দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি জাল বোনা ও মেরামত করে জীবিকা নির্বাহ করেন ১৬ শতাংশ। কৃষিকাজ করেন ১১ শতাংশ, লুকিয়ে মাছ ধরেন ৫ শতাংশ, শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণে অংশ নেন ২ শতাংশ, রিকশা-অটোরিকশা চালান ২ শতাংশ, ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন ২ শতাংশ। এভাবে নানাভাবে তাঁরা পরিবার নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেন।
৩৬৫ দিনের ১৪৮ দিনই নিষেধাজ্ঞা
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের নদ-নদী ও বঙ্গোপসাগরে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৪৮ দিনই মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। অক্টোবরে মা ইলিশ সংরক্ষণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, মার্চ-এপ্রিল মাসে ইলিশের ছয় অভয়াশ্রমে ৬০ দিনের নিষেধাজ্ঞা এবং এরপর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর বাইরে জাটকা রক্ষায় ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সময়ে নদ-নদীতে সাড়ে চার ইঞ্চির কম ব্যাসের জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এ নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার যে খাদ্যসহায়তা দেয়, তা সব জেলে পান না। আবার চাহিদার তুলনায় খুব চাল দেওয়া হয়। এ সহায়তা বিতরণেও রয়েছে নানামুখী অনিয়ম। তাই এ সময় বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় জেলেরা পরিবার নিয়ে ভীষণ কষ্টে দিন কাটান।
মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মো. আনিসুর রহমান তালুকদার বলেন, নিষেধাজ্ঞাকালে জেলেদের যাতে দুর্দশায় পড়তে না হয়, সে জন্য সরকার সহায়তা দিচ্ছে। যদিও এটা অপ্রতুল, তবে প্রতিবছরই সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সহায়তার বাইরেও সরকার বিকল্প জীবিকায়নের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে ভাবছে। এরই মধ্যে এর কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।