‘আমি তো উগের টাকাও দিলেম, তালি আমার ছাওয়াডাক মারল কেন’
বাড়ির উঠানে নির্বাক বসে ছিলেন দরিদ্র রিকশাচালক আবুল কাশেম (৫০)। চোখে পানি নেই। সন্তান হারানোর বিষাদ তাঁকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নীরবতা কাটিয়ে কিছুক্ষণ পর ডুকরে কেঁদে বলে উঠলেন, ‘আমি তো উগের টাকাও দিলেম, তালি আমার ছাওয়াডাক উরা মারল কেন। আমি বিচের চাই।’
পাবনার ঈশ্বরদীতে নিখোঁজের আট দিন পর গতকাল শনিবার বিকেলে আবুল কাশেমের ছেলে তপু হোসেনের (১৪) টুকরা করা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উপজেলা সদরের একটি মেসের কক্ষে রাখা ট্রাংকের ভেতর থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল রাতে তপুর বাবা আবুল কাশেম থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।
আজ রোববার সকালে তপুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা মজিরন বেগম বিলাপ করছেন। বলছিলেন, ‘বেটারে...আমার বেটাক (ছেলে) আনা দেও।’ তাঁর কান্নায় বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। প্রতিবেশী ও স্বজনেরা তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। একই জায়গায় বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন কিশোর তপুর বড় ভাই অপু।
স্থানীয় লোকজন জানান, নিহত তপুর বাবা আবুল কাশেম রিকশাচালক। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে তপু ছোট। ছেলেটি পড়ালেখা তেমন করেনি। মাঝেমধ্যে শ্রমিকের কাজ করত। সম্প্রতি বাড়ির পাশের একটি মেসে থাকা কিছু যুবকের সঙ্গে এই কিশোরের বন্ধুত্ব হয়।
তপুদের বাড়ি ঈশ্বরদী উপজেলা সদরের মশুড়িয়া পাড়া এলাকায়। ১৫ জুন বিকেল থেকে তপুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রাতে এই কিশোরের মুঠোফোন থেকে তার বাবার কাছে ফোন দিয়ে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। তিনি মুক্তিপণ হিসেবে বিকাশের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা দেন। এর পর থেকেই ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিষয়টি থানায় জানানো হলে পুলিশ মুঠোফোন নম্বরটি শনাক্ত করে তপুর খোঁজ শুরু করে। একপর্যায়ে সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা লাশের সন্ধান দেয়। পরে পুলিশ তপুদের বাড়ির পাশের একটি মেসে অভিযান চালিয়ে বাক্স থেকে তপুর টুকরা করা লাশ উদ্ধার করে।
তপুর ভাই অপু প্রথম আলোকে বলেন, তপু কারও সঙ্গে তেমন একটা মেলামেশা করত না। বাড়িতেই থাকত। মাঝেমধ্যে কাজ করত। নিখোঁজের পর তাঁদের দরিদ্র বাবা মুক্তিপণের টাকাও দিয়েছিল। এরপরও কেন তাঁর ভাইকে হত্যা করা হলো, তা বুঝতে পারছেন না। তিনি ভাই হত্যার বিচার চান।
কিশোর তপু হত্যার ঘটনায় আটক সন্দেহভাজন দুই যুবক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রোমহর্ষক তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, হত্যার পর লাশ গুমের জন্য টুকরা করা হয় ওই কিশোরকে। এরপর লাশের টুকরা বাক্সবন্দী করে মুক্তিপণ দাবি করে হত্যাকারীরা।
ঈশ্বরদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তের স্বার্থে আপাতত আটক দুজনের নাম বলা হচ্ছে না। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই খুনের সঙ্গে তিনজন জড়িত। তপু সম্প্রতি এই তিনজনের সঙ্গে বেশ মেলামেশা করত। কোনো কিছু নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। বিরোধের জেরে ১৫ জুন রাতে তপুকে মেসের তিন তলায় নিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুম করতে টুকরা করে পলিথিনে মুড়িয়ে বাক্সে রাখা হয়।
মনিরুল ইসলাম বলেন, আটক যুবকেরা নেশাগ্রস্ত। তাঁরা হত্যার পর নেশার টাকা জোগাতে তপুর বাবার কাছে মুক্তিপণ দাবি করেন। এরপর ১০ হাজার টাকা পেয়ে ফোনটি বন্ধ করে দেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দুজন খুনের কথা স্বীকার করেছেন। বাকি একজনকে ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।