দৃষ্টিহীন বাবা, স্ত্রী ও চার সন্তান রিপনের অপেক্ষায় ছিলেন, খবর এল মৃত্যুর

ঢাকার সদরঘাটে দুর্ঘটনায় নিহত রিপনের মরদেহ বাড়িতে পৌঁছালে বৃদ্ধ বাবা, সন্তান ও স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। আজ শুক্রবার দুপুরে পটুয়াখালী সদরের শিয়ালী গ্রামেছবি: প্রথম আলো

ঢাকায় মোটরসাইকেল রাইডারের কাজ করে ঈদের দিন বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন রিপন হাওলাদার। সবার জন্য কেনাকাটাও করেছিলেন। বাড়িতে ঈদের আনন্দ বইছিল। চার শিশুসন্তান বাবার পথের দিকে চেয়েছিল। রিপনের অপেক্ষায় ছিলেন স্ত্রী ও দৃষ্টিহীন বাবাও।

ঠিক তখনই ঢাকা সদরঘাটে দুর্ঘটনার খবর আসে। লঞ্চের রশি ছিঁড়ে যেখানে রিপন গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। এর পর থেকে ঈদের আনন্দের বদলে পরিবারটিতে কান্নার রোল পড়েছে।

রিপন হাওলাদার ছিলেন পরিবারের মধ্যমণি
ছবি: সংগৃহীত

রিপন হাওলাদারের (৩৮) বাড়ি পটুয়াখালীর সদর উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের শিয়ালী গ্রামে। রিপনের মা প্রায় এক যুগ আগে মারা গেছেন। বাবা জয়নাল আবেদীন হাওলাদার (৭০) দৃষ্টিহীন। সাত বোন ও পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে রিপন বড়। প্রায় ২০ বছর ধরে রিপন ঢাকায় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। বোনদের বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রী নার্গিস বেগম, ছেলে রিফাত (১২) ও তিন মেয়ে রিয়ামণি (১৩), মেঘলা (১০), দৃষ্টিকে (৮) নিয়ে ছিল রিপনের সংসার। তাঁর চার ভাই সোহেল হাওলাদার, রাসেল হাওলাদার, মুসা ও আল-আমিন বর্তমানে লেখাপড়া করছেন।

আরও পড়ুন

রাজধানীর সদরঘাটে গতকাল বৃহস্পতিবার ঈদের দিন বিকেলে একটি লঞ্চের ছিঁড়ে আসা রশির আঘাতে একই পরিবারের তিনজনসহ পাঁচ যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় জড়িত ফারহান-৬ ও তাসরিফ-৪ লঞ্চের চালকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে। লঞ্চ দুটি জব্দ করা হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, আসামিরা অবহেলাপূর্বক বেপরোয়া ও দ্রুতগতিতে লঞ্চ চালানোর কারণে লঞ্চের পুরোনো রশি ছিঁড়ে গিয়ে সেটার আঘাতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

নিহত রিপনের ভাই আল-আমিন বলেন, রিপন এক বছর ধরে ঢাকায় মোটরসাইকেল রাইডারের কাজ করতেন। ঢাকার গুলশানের নতুন বাজার এলাকায় স্ত্রী নার্গিস বেগমের বড় বোন হেলেনা বেগমের বাসায় থাকতেন। বছরে ঈদের সময় বাড়িতে আসেন এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেন।

আল-আমিন বলেন, ঈদের দিন ভিড় কম থাকবে। তাই রিপন হেলেনা বেগমের মেয়ে তানিয়াকে (১৮) নিয়ে প্রথমে বেতাগীর চান্দখালী শ্বশুরবাড়ি এবং পরে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে নিজ বাড়িতে আসবেন বলে জানিয়েছিলেন। তাই ঈদের দিন তানিয়াকে নিয়ে সদরঘাটে এসে লঞ্চে ওঠার অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় লঞ্চের ছিঁড়ে আসা রশি আঘাতে মারা যান রিপন।

রিপনের বোন নূপুর বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার এই ভাই অনেক কষ্ট করে ঢাকায় কাজ করে আমাগো বিয়ে দিছে। ভাইদেরসহ পরিবারের সব দায়িত্বই নিজে নিয়েছিলেন রিপন। এখন ভাই নাই, কীভাবে পরিবারটি চলবে...’ এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন নূপুর।

আরও পড়ুন

বছরে একবারই রিপন বাড়ি আসে। তাঁর দৃষ্টিহীন বাবা জয়নাল আবেদীন অপেক্ষায় ছিলেন ছেলে বাড়ি এলে হাতটা ধরে বুকে নেবেন। সেই আশা পূরণ না হওয়ার আক্ষেপ জানিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমাগো পুরো বাড়ির মধ্যমণি ছিল আমার রিপন। ওই সবাইকে সহায়তা করত। কিন্তু এই মৃত্যু কষ্টের কোনো সীমা থাকে না। আল্লাহ যাতে কাউকে এত কষ্ট না দেয়। এখন আমরা কী করুম, খোদায় এর আগে আমারে নিল না কেন!’

আজ শুক্রবার সকালে বরগুনার বেতাগী উপজেলার চান্দখালী গ্রামে শ্বশুরবাড়ি এসে রিপনের লাশ পৌঁছায়। সেখানে রিপনের স্ত্রী ও ছোট দুই মেয়ে ছিল। সকাল সাড়ে ৮টায় সেখানে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে মরদেহ নিজ বাড়ি পটুয়াখালীর শিয়ালী গ্রামে নেওয়া হয়। এ সময় বৃদ্ধ বাবা, ভাই, বোন ও স্ত্রী-সন্তানদের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কেউ খুঁজে পাচ্ছিলেন না উপস্থিত প্রতিবেশী-স্বজনেরা।

রিপনের ভাই সোহেল হাওলাদার জানান, জুমার নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে রিপনের দাফন সম্পন্ন হয়।

নিহত রিপনের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. নূর কুতুবুল আলম।