ছেলের বন্ধু ফোন করে কইল, ‘মারুফ ডেথ হয়্যা গেচে’
‘বেলা ১১টায় ছেলের সঙ্গে কথা হয়, তখনো মেসে সে খায়নি। ছেলে বলল, “ঢাকার অবস্থা ভালো না।” আমি কলাম, বাইরে বার হবা না। ছেলেও সায় দিল। তারপর বিকেল পাঁচটায় ছেলের বন্ধু ফোন করে কইল, “মারুফ ডেথ হয়্যা গেচে।’”
নিহত হওয়ার ছয় ঘণ্টা আগে ছেলে মারুফ হোসেনের (২১) সঙ্গে কথা হয়েছিল শরিফুল ইসলামের। তখনো তিনি বুঝতে পারেননি, ছেলের সঙ্গে এটাই তাঁর শেষ কথা।
শরিফুল ইসলামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা পৌরসভার থানাপাড়া এলাকায়। তাঁর ছেলে মারুফ ইন্টার্নশিপ করার জন্য ঢাকার রামপুরার বনশ্রী এলাকায় থাকতেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে ১৯ জুলাই বনশ্রী এলাকায় গুলিতে মারুফ নিহত হন। ২০ জুলাই রাতে খোকসায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
মারুফ কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে ১ জুলাই ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে ইন্টার্নিশিপ করছিলেন, উঠেছিলেন রামপুরার বনশ্রী এলাকার একটি মেসে। মারুফের বাবা শরিফুল ইসলাম খোকসা বাজারে ফুটপাতে ফল বিক্রি করেন। মা ময়না খাতুন গৃহিণী। কোনো রকমে তাঁদের সংসার চলে। দুই ভাই–বোনের মধ্যে মারুফ বড়। ছোট বোন মাইসা খাতুন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।
মেসে থাকা অন্য বন্ধুদের বরাত দিয়ে শরিফুল ইসলাম জানান, ১৯ জুলাই বিকেলে মেসের সামনে অন্যদের সঙ্গে মারুফও দাঁড়িয়ে ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধাওয়া দেখে মারুফসহ অন্যরা দৌড় দেন। একপর্যায়ে গুলি হয়। গুলিতে মারুফ আঘাত পেয়ে পড়ে যান। পরে অন্যরা তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ২০ জুলাই সকালে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। রাতে খোকসা পৌর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। পুলিশ বাড়িতে এসে মারুফের খোঁজখবর নিয়ে গেছে বলে জানান শরিফুল।
শরিফুল ইসলাম বলেন, যাঁরা গুলির চিহ্ন দেখেছেন, তাঁরা বলেছেন, গুলি পিঠে লেগে বুক দিয়ে বের হয়ে গেছে। সইতে পারবেন না ভেবে সাহস করে সেই ক্ষত চিহ্ন দেখতে পারেননি তিনি। শুধু ছেলের লাশের মুখটা দেখেছেন। মারুফকে ছোটবেলায় একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, সেটা আজও রয়েছে। ঘরে তাঁর পড়ার টেবিল, বই, সাইকেল, পোশাক—সবই আছে। সেগুলো স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে। ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন, চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে, সেই আশা ছিল শরিফুল ইসলামের।
কথা হয় মারুফের মায়ের সঙ্গে। মৃত্যুর পর ৯ দিন পেরিয়ে গেছে। ছেলের বিষয়ে তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছেন না। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত্রি কতা বলিছিল। বলল, “নেট নাই, কারেন্ট নাই। তাই ছাদে বসি আছি।” বললাম, বাপ, তুমি ঘরেতথি বার হইয়ো না। ছাওয়াল বলল, “আম্মু, বাইর হব না।” তারপরও কেমন করি কী হয়ে গেল।’
ছেলে নিহতের বিচার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ময়না খাতুন বলেন, ‘বিচার করি কী করবেন বলেন, ছেলে তো আমি আর পাচ্ছিনে।’
এরপর আর কোনো কথা বলতে পারলেন না ময়না খাতুন। বাক্রুদ্ধ হয়ে বসে থাকলেন। ছোট্ট মাইসা মায়ের কোল ঘেষে বসে ছলছল চোখে তাকাল। সে বলল, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ভাইয়া ফোন দিত। সন্ধ্যা নামলেই ভাইয়ের কথা বেশি মনে পড়ে।’