নবজাতককে শৌচাগারের পাইপের ভেতর দিয়ে ড্রেনে ফেলা হয়েছিল

ময়লার ড্রেনে পাওয়া নবজাতক। গত রোববার রাতে নরসিংদী সদর উপজেলার দাসপাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদী সদর উপজেলায় ময়লার ড্রেন থেকে জীবিত উদ্ধার করা নবজাতক মেয়েটিকে নিয়ে রহস্যের জট খুলেছে। এক নারী শিশুটি তাঁর বলে দাবি করেছেন। যদিও তিনি শিশুটির মা কি না, তা নিশ্চিত না হয়ে নবজাতককে হস্তান্তর করা হবে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাই সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আপাতত নবজাতকটিকে কোনো ছোটমণি নিবাসে পাঠানো হবে।

এদিকে স্থানীয় লোকজনের জিজ্ঞাসাবাদে নবজাতকটি জন্মের পর ময়লার ড্রেনে ফেলার বর্ণনা দিয়েছেন শিশুটির মা দাবি করা নারী সালমা বেগম (৫০)। তিনি ওই নবজাতককে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে গোসলখানা কাম শৌচাগারের ছয় ইঞ্চি প্লাস্টিকের পাইপের ভেতরে ঠেলে দেন। নবজাতকটি ময়লার ড্রেনে গিয়ে পড়ে। এর পরপরই তিনি পালিয়ে অন্যত্র চলে যান। তিনি সাংবাদিকদের সামনে তাঁর ভুল হয়েছে বলে দাবি করেছেন।

গত রোববার রাত সাড়ে নয়টার দিকে উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের দাসপাড়ার নার্সারি মোড় এলাকার আউয়াল মিয়ার বাড়ির ময়লার ড্রেন থেকে নবজাতকটিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। পরে গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ও নাড়ি কেটে দেওয়ার পর থানা-পুলিশের সহায়তায় ওই রাতেই তাকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাশাপাশি ১৩ কক্ষের বাড়িটিতে ৯টি পরিবার বসবাস করে। ঘটনার দিন রাত ৯টার দিকে সবাই যাঁর যাঁর ঘরে ছিলেন। ওই সময় থেমে থেমে নবজাতকের কান্না শুনতে পায় প্রতিবেশী একটি পরিবার। এই কান্নার শব্দ কোথা থেকে আসে, তার খোঁজ চালাতে বাড়িটির সবাই জড়ো হন। শিশুর কান্নার উৎস সন্ধান করতে করতে ড্রেনের পাশে এসে থমকে যান তাঁরা। পরে ড্রেনের ওপরের ঢাকনা খুলে দেখতে পান, প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো অবস্থায় নবজাতক পড়ে আছে।

এরপরই তাঁরা নবজাতকটিকে ওই ড্রেন থেকে উদ্ধার করে প্রতিবেশী কয়েকজন নারীর সহযোগিতায় গরম পানি দিয়ে শরীর পরিষ্কার করে ও নাড়ি কেটে বাড়ির মালিককে খবর দেন। এ সময় ঘটনা জানাজানি হলে স্থানীয় শতাধিক নারী-পুরুষ সেখানে জড়ো হন। এমন অবস্থায় থানা-পুলিশকে ঘটনা জানানো হলে নরসিংদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার ঘটনাস্থলে আসেন। পরে পুলিশের সহযোগিতায় ওই নবজাতককে নরসিংদী সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নবজাতকটিকে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে
প্রথম আলো

বাড়িটির বাসিন্দারা বলছেন, বাড়িটিতে যাঁরা বসবাস করেন, সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। তাঁদের একজন সালমা বেগম। ময়মনসিংহে বাড়ি হলেও এখানে থেকে তিনি এক রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১০ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে সালমার। অন্যদিকে কয়েক বাড়ি পরেই রংমিস্ত্রি রহম আলীর (৬০) বাড়ি। তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে প্রবাসী। এর আগেও রহম আলী আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। কয়েক বছর আগে কাজের সূত্রে সালমা বেগমের সঙ্গে রহম আলীর পরিচয় হলে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে সালমা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।

বাসিন্দারা আরও জানান, রোববার রাত ৯টা পর্যন্ত সালমা বেগম তাঁর ঘরেই অবস্থান করছিলেন। এর কিছুক্ষণ আগে তিনি ঘর লাগোয়া শৌচাগারে গেলে প্রসববেদনা ছাড়াই আকস্মিকভাবে তাঁর একটি কন্যাশিশু ভূমিষ্ঠ হয়। পরিবারের লোকজন কী বলবেন, এই আতঙ্কে তিনি নবজাতকটিকে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে শৌচাগারের দেয়াল লাগোয়া ৬ ইঞ্চি প্লাস্টিকের পাইপের ভেতরে ঠেলে দেন। ফলে নবজাতকটি ওই ময়লার ড্রেনে গিয়ে পড়ে। এর পরপরই তিনি ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে যান।

সালমা বেগম যে ওই নবজাতকের মা, এটি আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তাই শিশু কনসালট্যান্টের ছাড়পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আপাতত রাজধানী ঢাকার সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে পাঠানো হবে। এই নবজাতকের বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা যা নেওয়ার, এর সব তারাই নেবে।
লোপা চৌধুরী, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, নরসিংদী সদর হাসপাতাল

বাড়িটির মালিক আউয়াল মিয়া বলেন, যে ময়লার ড্রেন থেকে নবজাতককে উদ্ধার করা হয়, তা সালমা বেগমের শৌচাগার লাগোয়া। সালমা বেগম অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, বিষয়টি বাড়ির সবারই কমবেশি জানা ছিল। এ ছাড়া ঘটনার পর থেকেই তিনি পলাতক ছিলেন। এতে স্বাভাবিকভাবেই সবার সন্দেহ ছিল তাঁর দিকেই। তাঁর মেয়ের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে ঘটনার পরদিন রাতে স্থানীয় লোকজন তাঁকে ধরে আনেন এবং প্রকৃত সত্য জানতে চান। একপর্যায়ে সালমা বেগম সবার সামনে স্বীকার করেন, নবজাতকটি তাঁর এবং রহম আলীর। পরে রহম আলীকেও ধরে আনা হলে তিনিও সবার সামনে সবকিছু স্বীকার করেন। পরে স্থানীয় একজন হুজুর ডেকে তাঁদের বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পর থেকে রহম আলীকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।

নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নবজাতকের পাশে বসে সালমা বেগম গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রহম আলীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল তিন বছর আগে। গোপনে বিয়ে হওয়ায় বিষয়টি কেউ জানত না। হঠাৎ করে সন্তান প্রসব হয়ে যাওয়ায় তিনি ভয় পেয়ে যান। রহম আলী এই সন্তানকে নষ্ট করে ফেলার কথা বলেন। তাৎক্ষণিকভাবে কী করবেন, সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে তিনি এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। শৌচাগারের পাইপের ভেতর দিয়ে ময়লার ড্রেনে ঠেলে দিয়েছিলেন সদ্যোজাত নবজাতককে। তিনি বলেন, ‘এখন বুঝতে পারছি, কাজটি অন্যায় করেছিলাম।’

সালমা বেগম আরও বলেন, ঘটনার পর পালিয়ে গেলেও মঙ্গলবার বিকেল থেকে হাসপাতালে এসে নবজাতকের সঙ্গে থাকছেন। শিশুটিকে এখন থেকে তিনি নিজের কাছেই রাখতে চান। তবে হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে, তাঁর মেয়েকে নাকি তারা ঢাকায় পাঠিয়ে দেবে। এদিকে রহম আলীকেও এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝতে পারছেন না, কী করবেন।

নরসিংদী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) লোপা চৌধুরী বলেন, ‘এক দিন বয়সী মেয়ে নবজাতকটিকে একজন শিশু কনসালট্যান্টের তত্ত্বাবধানে রেখে আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। সময়ের আগে হয়ে যাওয়ায় নবজাতকটির ফিডিং ও ওজনের কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। আমরা তাকে ইনজেকশন ও স্যালাইনের মধ্যে রাখছি।’

নবজাতকটি মায়ের কোলে ফিরবে কি না, জানতে চাইলে আরএমও বলেন, ‘সালমা বেগম যে ওই নবজাতকের মা, এটি আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তাই শিশু কনসালট্যান্টের ছাড়পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আপাতত রাজধানী ঢাকার সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে পাঠানো হবে। এই নবজাতকের বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা যা নেওয়ার, এর সব তারাই নেবে।’

নরসিংদী মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার বলেন, ‘স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে শুনেছি, ওই নবজাতকের মা-বাবা সালমা বেগম ও রহম আলী। তাঁরা নিজেরাও নাকি নবজাতকটি তাঁদের বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার আগপর্যন্ত নবজাতককে তাঁদের জিম্মায় দেওয়া উচিত হবে না। তাই সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আপাতত নবজাতকটিকে কোনো ছোটমণি নিবাসে পাঠাতে চাই আমরা।’

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মাসুদুল হাসান বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে আমি নিজেও নবজাতক শিশুটির তদারকি করছি। আমাদের রোগী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে তার জন্য পথ্য ও দুধের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পাশাপাশি নবজাতকটির প্রকৃত বাবা-মাকেও শনাক্তের চেষ্টা চলছে। যত দূর আমরা তদন্ত করেছি, মনে হচ্ছে সালমা বেগমই নবজাতকটির মা। তবে তদন্ত শেষ হলেই এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারব। আর নিশ্চিত হতে পারলেই নবজাতককে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

মাসুদুল হাসান আরও বলেন, ‘এই ধরনের ক্ষেত্রে আমরা শিশুদের সরকারি খরচে লালন-পালনের জন্য ছোটমণি নিবাসে পাঠাই। পরবর্তী সময়ে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুদের প্রকৃত অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’