পাবনার সুজানগরে ফটোসেশনের পর ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র ‘গায়েব’

চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিটি কৃষিযন্ত্র অন্তত তিন বছর ব্যবহার করতে হবে। কৃষি বিভাগের অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর বা স্থানান্তর করা যাবে না।

আনুষ্ঠানিক ফটোসেশনের মধ্য দিয়ে কৃষকদের মধ্যে ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র বিতরণ করা হয়। ৬ মে সুজানগর উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণেছবি: সংগৃহীত

পাবনার সুজানগর উপজেলায় কৃষকদের জন্য ৩১ লাখ টাকার ৯টি আধুনিক কৃষিযন্ত্র দেওয়া হয়েছে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। বাকি ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে এসব কৃষিযন্ত্রের মধ্যে ৫টি কৃষকদের কাছে হস্তান্তর করেছে কৃষি বিভাগ, হয়েছে ফটোসেশনও। তবে ৩টি কৃষিযন্ত্রের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, কৃষিযন্ত্রগুলো কৃষকদের বাড়িতে পৌঁছায়নি। হস্তান্তর অনুষ্ঠানের পরপরই যন্ত্রগুলো অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

সুজানগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুজানগরে কৃষকদের জন্য ৯টি আধুনিক কৃষিযন্ত্র বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৫টি গত ৬ মে উপজেলা কৃষি বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষকদের কাছে হস্তান্তর করে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও দামিটি ছিল কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন। কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিটি কৃষিযন্ত্র অন্তত তিন বছর ব্যবহার করতে হবে। কৃষি বিভাগের অনুমতি ছাড়া যন্ত্রগুলো হস্তান্তর বা স্থানান্তর করা যাবে না।

কৃষি বিভাগের তালিকা অনুযায়ী, পাঁচটি কৃষিযন্ত্রের একটি রিপার মেশিন (ধান ও গম কাটার যন্ত্র) পেয়েছেন ভায়না গ্রামের আনিসুর রহমান। একটি মেইজ শেলার মেশিন (ভুট্টা কাটার যন্ত্র) পেয়েছেন গোপালপুর গ্রামের ইয়াসিন আলী প্রামাণিক। বাকি তিনটি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনের (ফসল লাগানো, কাটা, শুকানো, ঝাড়া, মাড়াই সবকিছু করা যায়) মধ্যে একটি পেয়েছেন আদোয়া গ্রামের দুলাল সরদার, একটি উত্তর বনকোলা গ্রামের আরিফুল ইসলাম এবং অপরটি পেয়েছেন হাটখালি দক্ষিণ পাড়া গ্রামের জয়নাল শেখ।

আদোয়া গ্রামের কৃষক দুলাল সরদারের বড় ভাই আলাল সরদার বলেন, তিনি তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে কোনো দিন ওই যন্ত্র (কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন) দেখেননি। তাঁর ভাইয়ের এমন যন্ত্র আছে বলেও শোনেননি।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঁচটি কৃষিযন্ত্রের মধ্যে রিপার মেশিন ও মেইজ শেলার দুই কৃষকের বাড়িতে আছে। কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন তিনটি কোনো কৃষকের বাড়িতে পৌঁছায়নি।

১৬ অক্টোবর ওই তিনজন কৃষকের বাড়িতে গিয়ে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন পাওয়া যায়নি। তিনজনের কাউকে বাড়িতেও পাওয়া যায়নি। তিনজনের মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁদের বাড়ির লোকজন, এমনকি প্রতিবেশীরা যন্ত্রগুলো দেখেননি বলে জানান। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, যন্ত্রগুলো তাঁরা গ্রহণ করলেও কেউ এলাকায় নেননি। হয়তো তাঁরা যন্ত্রগুলো বেশি দামে বিক্রি করে দিয়েছেন।

আদোয়া গ্রামের কৃষক দুলাল সরদারের প্রতিবেশী আকমল হোসেন বলেন, অন্য এলাকা থেকে ধান কাটার যন্ত্র তাঁদের গ্রামে আসে। তাঁরা এসে টাকার বিনিময়ে ধান কেটে দিয়ে যান। কিন্তু গ্রামের কারও এই যন্ত্র আছে বলে তিনি জানেন না।

বোনকোলা গ্রামের আরিফুল ইসলামের প্রতিবেশী মো. মনিরুজ্জামান জানান, তিনি জানেন না আরিফুলের কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন আছে। আরিফুলের বাড়িতে মেশিনটি দেখেননি।

জানতে চাইলে সুজানগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাফিউল ইসলাম বলেন, যন্ত্রগুলো তাঁরা সরাসরি কৃষকদের দেন না। কৃষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প থেকে অনুমোদন হলে কৃষকদের পছন্দ অনুযায়ী কোম্পানির সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করিয়ে দেন। ভর্তুকির টাকা ঢাকার প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয় থেকেই অনুমোদন হয়। পরবর্তী সময়ে কিছু শর্ত সাপেক্ষে কৃষকদের যন্ত্রগুলো দেওয়া হয়। শর্ত অনুযায়ী, তিন বছরের আগে কৃষকেরা এসব যন্ত্র অন্য কোথাও সরাতে পারবেন না। সরাতে হলে কৃষি বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে।

সব শর্ত মেনেই কৃষকদের মেশিনগুলো দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে রাফিউল ইসলাম বলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁরা মেশিনগুলো অন্যত্র সরাতে পারেন। কিন্তু সরানোর কোনো অনুমোদন নেননি। তবে শর্ত অমান্য করলে কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান আছে। আগামী ২০ দিনের মধ্যে তাঁদের যন্ত্রগুলো হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তালিকায় থাকা তিন কৃষকের বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি এবং মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। অবশ্য পরে সরকারি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন পাওয়া কৃষক আরিফুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কিছু বাড়তি আয়ের জন্য তাঁর যন্ত্রটি সিলেটের হাওরে ধান কাটতে পাঠিয়েছেন। দ্রুতই সেটি এলাকায় নিয়ে আসবেন। কৃষি বিভাগের অনুমোদন বিষয়ে তিনি বলেন, অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি মনে ছিল না।