মামলার ৬ বছর পর নোটিশ পেয়ে হাওরে বাঁধ দুর্নীতি মামলার সাক্ষীর ক্ষোভ

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার হাওরের একটি ফসল রক্ষা বাঁধ
ফাইল ছবি

সুনামগঞ্জের হাওরে ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে ব্যাপক ফসলহানির পর ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছিল। দুটি মামলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা, বাঁধের কাজের ঠিকাদার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) লোকজনকে আসামি করা হয়। তখন বিষয়টি দেশব্যাপী আলোচিত ছিল।

এ দুই মামলার একটিতে সাক্ষ্য দিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে গতকাল বুধবার ডাকযোগে একটি চিঠি পেয়েছেন হাওর বাঁচাও আন্দোলন নামের সংগঠনের সহসভাপতি অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক চিত্তরঞ্জন তালুকদার। ছয় বছর পর এই চিঠি পেয়ে ক্ষুব্ধ তিনি।

ওই চিঠি চিত্তরঞ্জন তালুকদার নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘১২ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় সিলেটের দুদকের আঞ্চলিক কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তাঁকে এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান করা হয়েছে। অনুপস্থিতিতে কোনো বক্তব্য নেই মর্মে গণ্য করা হবে।’

বিস্ময় প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন তালুকদার পোস্টে আরও লেখেন, ‘চিঠি চালাচালিতেই ছয় বছর গেল। হাওরের কৃষকের কী হবে? কী করব? প্রিয় পাঠক, ফেসবুক বন্ধু চিঠির মর্মার্থ বুঝে পরামর্শ দিন, মন্তব্য করুন।’ পরে তিনি যুক্ত করেন, ‘সংক্ষেপে আমার জবাব হলো, মামলায় উল্লেখিত অভিযোগগুলোর সঙ্গে আমি একমত। এখন আপনি দুদক, হাওরপাড়ে গিয়ে সত্য-মিথ্যা খুঁজে বের করুন। যথাসাধ্য আসামিকে আইনের আওতায় আনুন। আরও দেরি হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বেগমপাড়া পাড়ি জমাবে, আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা পটল তুলবে।’

দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক ও তদন্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ সোহেল স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে উল্লেখ করা মামলার ১৩ সাক্ষীর মধ্যে ৩ জন মারা গেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাওর বিপর্যয়ের পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুনামগঞ্জে ছুটে আসেন, কৃষকদের পাশে দাঁড়ান। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ছয় বছর আগে। কাগজপত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে আছে। এখন সাক্ষীদের খোঁজ কেন? আর টাকা খরচ করে সিলেটে যাব কেন? দরকার হলে তারা (দুদক) সুনামগঞ্জে আসবে।’

সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট মামলাটি করেছিলেন সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল হক। বিশেষ জজ আদালতে করা মামলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৫ কর্মকর্তা, ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে নিয়োজিত ৪৬ জন ঠিকাদার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) ৭৮ সদস্যসহ ১৩৯ জনকে আসামি করা হয়। আদালত মামলা আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য দুদককে আদেশ দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। পরে বাদী ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজির আবেদন দেন। আবেদনের দীর্ঘ শুনানি শেষে গত ১৯ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ জাকিয়া সুলতানা দুদককে আবার তদন্তের নির্দেশ দেন।

২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪টি হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যায়। তখন হাওরে ফসলহানির পর ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। ১৩ এপ্রিল হাওরের ফসলহানি ও বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের তদন্তে দুদক একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। ১৫ এপ্রিল পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দিনকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করা হয়। ফসলহানির ঘটনায় ৩০ মে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

দুদকের অনুসন্ধান শেষে ২ জুলাই দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক ফারুক আহমদ বাদী হয়ে পাউবো কর্মকর্তা, ঠিকাদারসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় পাউবোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও ঠিকাদারদের সঙ্গে অবৈধ যোগসাজশের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আর ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ঠিক সময়ে কাজ শেষ না করে কৃষকদের ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়। দুদকের করা এই মামলায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তবে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই অভিযোগপত্র তখন প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছিল, অভিযোগপত্রে মূল অপরাধীদের রাখা হয়নি।