দেশে শীত আসতে না আসতেই উদ্ধার ১২টি হিমালয়ান গৃধিনী
শীত আসতে না আসতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্লান্ত ও অসুস্থ ১২টি হিমালয়ান গৃধিনী (শকুন) উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে একটি। সর্বশেষ গতকাল শনিবার রাতে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার বুড়ইল ইউনিয়নের মুরাদপুর গ্রাম থেকে একটি হিমালয়ান গৃধিনী (Himalayan Griffon) উদ্ধার করা হয়েছে।
দীর্ঘপথ ভ্রমণের ক্লান্তিতে নন্দীগ্রামের ফসলের জমিতে নেমে আসা শকুনটি প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট ‘আইইউসিএন’–এর সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে এটির পরিচর্যা করছেন বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘তীর’-এর (টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ) স্বেচ্ছাসেবীরা।
‘আইইউসিএন’–এর শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের মুখ্য গবেষক সারোয়ার আলম (সীমান্ত দীপু) প্রথম আলোকে বলেন, আইইউসিএন ও বন বিভাগের সহযোগিতায় এ বছর মোট ১২টি হিমালয়ান গৃধিনী উদ্ধার করা হয়েছে। প্রথমে গত সেপ্টেম্বরে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থেকে একটি শকুন উদ্ধার করা হয়। গত দুই সপ্তাহে ঢাকার আশপাশের কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদী থেকে দুটি, গাইবান্ধা থেকে ছয়টি, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থেকে একটি হিমালয়ান গৃধিনী উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গতকাল বগুড়া ও কুমিল্লা থেকে এ প্রজাতির দুটি শকুন উদ্ধার করা হয়।
প্রতিবছর এ রকম শ খানেক শকুন আসে এবং এর মধ্যে প্রায় ৪০টি অসুস্থ হয়ে পড়ে বলে জানান সারোয়ার আলম।
তিনি আরও বলেন, গাইবান্ধায় উদ্ধার হওয়া ছয়টি শকুনের একটি মারা গেছে। বর্তমানে বগুড়া ও কুমিল্লায় প্রাথমিক পরিচর্যায় রাখা হয়েছে দুটি হিমালয়ান শকুন। ঢাকার আশপাশ থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি শকুন রয়েছে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। বাকি সাতটি দিনাজপুরের সিংড়া জাতীয় উদ্যানে ‘শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্রে’ হস্তান্তর করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় নন্দীগ্রামের মুরাদপুর গ্রামের একটি ফসলি জমিতে পড়ে ছিল বিশালাকৃতির একটি শকুন। স্থানীয় লোকজন অশুভ পাখি ভেবে এটিকে মেরে ফেলতে চাইছিলেন। সে সময় গ্রামের কয়েকজন তরুণ জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ ফোন দেন। সেখান থেকে বিষয়টি জানানো হয় সারোয়ার আলমকে। তিনি ‘তীর’-এর স্বেচ্ছাসেবকদের শকুনটি উদ্ধারের জন্য পাঠান।
‘তীর’–এর সাধারণ সম্পাদক হোসেন রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতেই আমাদের সংগঠনের সভাপতি রিফাত হাসান, সহসভাপতি মুকিম মাহমুদ ও সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে শকুনটি উদ্ধার করি। সুস্থ হওয়ার পর হিমালয়ান গৃধিনীটি ‘শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্রে’ হস্তান্তর করা হবে। বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার হওয়া অসুস্থ হিমালয়ান গৃধিনী পুরো শীতকাল এ কেন্দ্রে রাখা হবে। এরপর আগামী বছরের ৪ এপ্রিল এগুলো অবমুক্ত করে স্যাটেলাইট ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে।’
বাংলাদেশে সাত প্রজাতির শকুন ছিল। এর মধ্যে রাজশকুন পুরোপুরি বিপন্ন হয়ে গেছে। এ দেশের স্থায়ী বাংলা শকুন ও সরুঠোঁটি শকুনও রয়েছে খুবই কম। আইইউসিএনের হিসাবে, দেশে ২৬০টির মতো বাংলা শকুন টিকে আছে। এ ছাড়া দেশে তিন প্রজাতির পরিযায়ী শকুন দেখা যায়। এর মধ্যে হিমালয়ান গৃধিনী অন্যতম।
গবেষক সারোয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, হিমালয়ের ঠান্ডা ও হিমঝড়ের কারণে নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে হিমালয়ান গৃধিনীগুলো সমতলের দিকে আসে। মার্চের দিকে আবার চলে যায়।
একেকটা শকুনকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার আকাশপথ পাড়ি দিতে হয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সমতলে এসে এরা পর্যাপ্ত খাবার পায় না। তাই ভ্রমণক্লান্তিতে বিভিন্ন এলাকায় মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়।
আইইউসিএনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, প্রচারণার ফলে বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের যেকোনো স্থানে অসুস্থ শকুন পেলে স্থানীয় লোকজন তীরের স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে খবর দেন। স্বেচ্ছাসেবীরা সেগুলো উদ্ধার করে প্রাথমিক পরিচর্যার পর ‘শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্রে’ হস্তান্তর করেন।
সারোয়ার আলম বলেন, একেকটি হিমালয়ান গৃধিনীর ওজন ১৩ কেজি পর্যন্ত হয়। তবে বাংলাদেশে এদের যখন পাওয়া যায়, তখন ওজন থাকে চার-পাঁচ কেজি। মরা প্রাণীই এদের প্রধান খাদ্য। খাদ্য ও বাসস্থানসংকটে দেশে শকুনদের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।