মা-বাবা হারানো চিন্ময় আঁকড়ে রইলেন পড়ালেখা, মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ
মাকে হারানোর পর হারালেন বাবাকেও। এরপর হারালেন ভিটেমাটিও। আঁকড়ে ধরে রইলেন কেবল পড়ালেখাটাকে। সুফল মিলল সেটির। চাঁদপুর মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ পেলেন অদম্য মেধাবী চিন্ময় দাশ।
চিন্ময়ের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কেলিশহর গ্রামে। তাঁরা তিন ভাই। চিন্ময়ের বড় ভাই তন্ময় দাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবার স্নাতক পাস করেছেন। আর ছোট ভাই নিলয় দাশ পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে। প্রায় ১৫ বছর আগে তাঁদের মা সবিতা দাশ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আর ২০২০ সালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাবা উজ্জ্বল দাশ। দারিদ্র্যের সংসারের ধারকর্জ শোধ করতে ভিটেমাটির জায়গাটিও বিক্রি করতে হয় তাঁদের বাবাকে। সে জন্য বছর চারেক ধরে নিজেদের গ্রামেই ছোট দুটি পুরোনো কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন তাঁরা।
চিন্ময় দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেডিকেলে চান্স পাওয়ার খবর শুনে গ্রামবাসীসহ স্বজনেরা খুশি হয়েছেন। যে মা-বাবার পরিশ্রমে এতটুকু এসেছি, আজ তাঁরা বেঁচে থাকলেও আরও অনেক বেশি খুশি হতেন। তাঁরা আমার সাফল্য দেখে যেতে পারেননি, এটা অনেক বড় কষ্টের।’
অদম্য মেধাবী চিন্ময় দাশ ২০২০ সালে কেলিশহর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। চলতি বছর পটিয়ার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায়ও পান জিপিএ-৫। এর আগে পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি।
চিন্ময়ের বাবা উজ্জ্বল দাশ ২০১৪ সাল পর্যন্ত ডাকঘরের পোস্টাল অপারেটের হিসেবে চাকরি করেন। স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকা ঋণ করতে হয় তাঁকে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি নিজেও স্ট্রোক করেন। এরপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে এককালীন টাকা তুলে এবং পেনশন বিক্রি করে কয়েকজন পাওনাদারের টাকা শোধ করেন। তাতেও ঋণ শেষ না হওয়ায় নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে দেন। চাকরি ছাড়ার পর উজ্জ্বল দাশ রাজমিস্ত্রির সহকারী, মাটি কাটার শ্রমিক ও দিনমজুরি হিসেবে কাজ করতেন। অভাবের কারণে ছেলেদের সব সময় বই, খাতা, কলম এমনকি ঠিকমতো ভরণপোষণের টাকাও দিতে পারতেন না।
২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার পর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চিন্ময়ের পাশে দাঁড়ায় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট। এ জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টকে ধন্যবাদ জানান তিনি। চিন্ময় বলেন, ‘আমার নিদারুণ অসহায় অবস্থায় হঠাৎ প্রথম আলো ট্রাস্ট পাশে এসে দাঁড়াবে সেই চিন্তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। ঘরে চাল কেনার টাকা ছিল না। এমন সময়ে বই কেনার জন্যও দুই হাজার টাকার দরকার। তখন টিউশনির কিছু টাকা হাতে ছিল। বাকি টাকা কোথায় পাবে? এ নিয়ে চিন্তায় পড়েছি। পরে ব্যাংকে গিয়ে দেখি ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা এসে গেছে। তখন এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে!’
মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে কোনো কোচিংয়ে ভর্তি হননি চিন্ময়। কারও কাছে প্রাইভেটও পড়েননি। যতটুকু পড়েছেন; পুরোটাই নিজে নিজে। তিনি বলেন, ‘কখনো ঘড়ি দেখে পড়ালেখা করিনি। যতক্ষণ ইচ্ছে পড়তাম। কখনো ৭ ঘণ্টা, কখনো ৮ ঘণ্টা পড়তাম। নিয়মিত পড়ালেখায় এই সাফল্য এসেছে।’ ভবিষ্যতে ভালো চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে মানুষের সেবা করতে চান চিন্ময়।