নৃত্যের তালে দেবতাকে শস্য উৎসর্গ করে রাজশাহীতে গারোদের ওয়ানগালা
গারো নারীদের চুলের খোঁপায় মোরগের পালক। পরনে বর্ণিল নাচের পোশাক। হাতে শস্যের ডালা। নৃত্যের মাধ্যমে গারোদের ১১ সম্প্রদায়ের নারীরা প্রতীকীভাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে এ শস্য উৎসর্গ করেন। প্রতিটি সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একটি করে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হলো।
এভাবেই শনিবার রাজশাহীতে প্রথমবারের মতো উদ্যাপিত হলো গারো সম্প্রদায়ের ওয়ানগালা (নবান্ন উৎসব)। নগরের বাগানপাড়ায় ক্যাথিড্রাল চার্চ প্রাঙ্গণে এ উপলক্ষে দিনব্যাপী নানা আয়োজন করে রাজশাহী ওয়ানগালা উদ্যাপন পরিষদ।
শস্য সমর্পণে ১১টি খুঁটি দিয়ে একটি প্রাঙ্গণ ঘেরা হয়েছে। প্রতিটি খুঁটির মাথায় একটি করে মোমবাতি। সঙ্গে ঝুলছিল অতং, ডুয়াল,আ-উই, আ-বেঙ, রুগা, মে-গাম, চিসক, মাতচি, মতাবেঙ, চিবোক ও গারা-গানচিং সম্প্রদায়ের নাম। আগের দিনে শস্যদেবতার কাছে এভাবেই রীতি মেনে গারো নারীরা উৎপাদিত শস্য সমর্পণ করতেন। কিন্তু তাঁরা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করায় তাঁদের সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পণ করেন। আর ১১টি মোমবাতিতে ঘেরা প্রাঙ্গণের ভেতরে ছিল খ্রিষ্টের ক্রুশ। তাতেই খুতুব (পাগড়ি) পরানো হয়।
আয়োজনের ধাপে ধাপে ছিল নৃত্যগীত। এক পাশে মাদল আর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গারো নারী-পুরুষ অনবরত গেয়ে যাচ্ছিলেন গান। আর কোনো কোনো পর্বে শুধু যন্ত্রসংগীতের সুর বাজছিল। এতে অনুষ্ঠানের পরিবেশ মোহনীয় হয়ে ওঠে। শুরুতেই ছিল থক্কা অনুষ্ঠান। এ পর্বে নতুন ধানের আতপ চালের গুঁড়া মাখিয়ে অতিথিদের কপালে টিপ দেওয়া হয়। এ পর্বে গারো নারী সূচি, সিঁথি, চারমিং ও তাঁর দল থক্কা পরিবেশন করেন।
আনুষ্ঠানিকতার শুরুতেই নূপুর ও তাঁর দল সেজেগুজে নৃত্যের তালে তালে অতিথিদের মঞ্চে বরণ করে নেন। গারো নকমা লোটাস লুক চিসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী ধর্ম প্রদেশের ভিকার জেনারেল রেভা. ফা. ফাবিয়ান মার্ডি। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীর উপ-আঞ্চলিক পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, চ্যানেল আইয়ের রাজশাহীর স্টাফ রিপোর্টার আবু সালেহ্ মোহাম্মদ ফাত্তাহ, নানকিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এহসানুল হুদা, রাজশাহী ক্রিশ্চিয়ান মিশন হাসপাতাল নার্সিং ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল সুলতা দ্রং, নাসরিন হুদা প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন সুগন্ধা বিউটি পারলারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও স্বত্বাধিকারী আরিফা হক এবং রেইনি পার্কের স্বত্বাধিকারী রুমিলা আক্তার।
অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক কলেশ্বর রিছিল স্বাগত বক্তব্য দেন। ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের ইতিহাস ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বক্তব্য দেন দিব্য আগিদক। তিনি বলেন, গারোদের মিথ অনুযায়ী তাঁরা শুরুতে শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এক দিন এক শিকারি শিকার করতে গিয়ে কোনো শিকার পেলেন না। বাড়িতে না ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। একসময় স্বপ্ন দেখেন, শস্যের দেবতা তাঁর হাতে শস্য ও সবজির বীজ দিয়ে চাষ করতে বলছেন এবং নতুন ফসল উঠলে দেবতাকে যেন উৎসর্গ করেন, সেটা বলেন। ভালো ফসলের জন্য কৃতজ্ঞতা ও ভবিষ্যতে যাতে ভালো ফসল হয়, সে জন্য এর মাধ্যমে দেবতাকে ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে ফসল উৎসর্গের পর্বটি গারো নারীরা নৃত্যের মাধ্যমে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেন। প্রথমে তাঁরা জুমচাষের জন্য জমি খুঁজতে আসেন। জমি পছন্দ হলে সেই জমির জঙ্গল সাফ করেন। পাশে ফসল রোপণ করেন। ফসল কাটেন। তারপর উৎসবের দিন তাঁরা স্নান করে একে অপরের গায়ে জল ছিটিয়ে আনন্দ করেন। শেষে উৎপাদিত ফসল নিয়ে দেবতাকে উৎসর্গ করতে যান। নৃত্য, গান ও কথা মিলিয়ে চলে অনুষ্ঠান। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দল, একটি পাহাড়িয়া দল, সাঁওতাল দল তাদের নিজে নিজ ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা নিয়ে আসে। এ ছাড়া অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব ছিল খেলাধুলার আয়োজন।