কেঁচো সার বিক্রির টাকায় নারীদের কেউ কিনেছেন গরু, কেউ বানালেন শৌচাগার
ফটিকছড়ি উপজেলার বিবিরহাট বাজার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম রাঙ্গাপানি। গ্রামের একচালা মাটির ঘরে কোনোরকম দিন কাটান উষা বালা নাথ। চার বছর আগেও তাঁর ঘরে মানসম্মত শৌচাগার ছিল না। ভাঙাচোরা শৌচাগার ব্যবহার করতে অস্বস্তিতে পড়তে হতো পরিবারের সদস্যদের। আর্থিক সংগতি ছিল না বলে শৌচাগার মেরামতও করতে পারেননি এই গৃহিণী। এখন তাঁর বাড়িতে দুটি পাকা শৌচাগার। নিজের তৈরি কেঁচো সার বিক্রির টাকায় তিনি শৌচাগার নির্মাণ করেছেন। সংসারের খরচও চালাচ্ছেন।
উষা বালার স্বামী দিলীপ নাথ স্থানীয় একটি চা–বাগানের শ্রমিক। সাকল্য ১৪ হাজার টাকা বেতন পান। তাঁদের পরিবারে ছয় সদস্য। অভাব তাড়াতে বছর দুয়েক আগে ছোট ছেলে নয়ন নাথকে পাঠিয়েছেন ওমানে। বড় ছেলে স্বপন নাথ চট্টগ্রাম নগরের রেয়াজউদ্দিন বাজারের একটি সবজির আড়তে কাজ শুরু করেছেন। এ ছাড়া বছর তিনেক আগে মেয়েকে বিয়ে দেন হাটহাজারীর সরকারহাটে।
দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা উষা বালা নাথ আগে সংসারের কাজ করেই সময় পার করতেন। আয় বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু ২০২০ সালে শুরু করেন কেঁচো সার উৎপাদন। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে তিনি কেঁচো সার তৈরির এ কাজে নামেন। গত দুই বছরে সার বিক্রি করে তিনি শুধু শৌচাগারই তৈরি করেননি, কিনেছেন হাঁস-মুরগিও। এ ছাড়া ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে খরচ করেছেন এই সার বিক্রির টাকা।
শুধু উষা বালা নাথ নন, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার অন্তত ১০০ নারী বর্তমানে এই কেঁচো সার উৎপাদন ও বিক্রি করে আয় করছেন। সার বিক্রির টাকায় কেউ গরু কিনেছেন, কেউ সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন। তাঁরা কেউ তিন বছর আগে, কেউ দুই বছর আগে শুরু করেছেন সারের উৎপাদন। এই নারীদের উদ্যোগ নিয়ে আলাপকালে ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে জানালেন, তাঁদের হিসাবে উপজেলায় অন্তত দেড় শ ব্যক্তি কেঁচো সার উৎপাদনে জড়িত। এর মধ্যে ১০০ জনই নারী। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে এই নারীদের বসবাস। তাঁদের উৎপাদিত সার পৌঁছে যাচ্ছে রাঙামাটি, ফেনী, বোয়ালখালী, রাউজানসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। এ ছাড়া রাঙ্গাপানি গ্রামে একসঙ্গে ৩০ নারীর একটি দল তৈরি হয়েছে। তাঁদের সমিতিও রয়েছে। দলবদ্ধভাবে তাঁরা সার উৎপাদন করছেন এবং সচ্ছল হচ্ছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাবে, বর্তমানে প্রতি মাসে ফটিকছড়িতে প্রায় এক হাজার কেজি কেঁচো সার উৎপাদন করেন নারীরা। তবে সবাই সমানতালে উৎপাদন করেন, বিষয়টি এমন নয়। কেউ নিয়মিত ভালো পরিমাণে উৎপাদন করেন, আবার কেউ অন্য কাজের ফাঁকে এ খাতে সময় দেন।
নারীদের দিনবদল
সম্প্রতি রাঙ্গাপানি গ্রামের দিলীপ মিস্ত্রি পাড়ার সরু মেঠো পথ ধরে যেতে যেতে চোখে পড়ল বেশ কিছু মাটির ও বেড়ার ঘর। পাড়ায় ঢোকার মুখে রাস্তার ওপর রাখা ছিল বস্তায় বস্তায় কেঁচো সার। কথা বলে জানা গেল, এসব সার বিক্রির জন্য স্তূপ করে রেখেছেন উষা বালা নাথ। ক্রেতা এলে গাড়িতে তুলে দেবেন তিনি।
পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে উষা বালার বাড়ি। সেখানে গিয়ে কেঁচো সার তৈরির কর্মযজ্ঞ দেখা গেল। তাঁদের উঠানের এক কোনায় বেড়া আর টিনের ছাউনিতে বানানো হয়েছে একচালা ঘর। ঘরের ভেতর বসানো হয়েছে ১৫টি চাড়ি (সিমেন্টের রিং)। এসব চাড়ির কোনোটিতে গোবর, কোনোটিতে কেঁচো রাখা হয়েছে। ঘরের সামনেই সার ছেঁকে আলাদা করার যন্ত্র। সেখানে একমনে কাজ করে যাচ্ছিলেন উষা বালা নাথ।
কাজের ফাঁকে তিনি প্রথম আলোকে বললেন, দুই বছর ধরে গড়ে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। প্রথম বছর ক্রেতা কম থাকায় আয় কম হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে বেড়েছে।
কেঁচো তৈরির প্রক্রিয়া তুলে ধরেন উষা বালা। কেঁচো সার তৈরির পদ্ধতি হলো একটি রিং বা চাড়ির মধ্যে দুই ভাগ গোবর ও এক ভাগ সবজির উচ্ছিষ্টাংশ রেখে দিতে হবে। কলাগাছের টুকরাও দেওয়া যায়। এক সপ্তাহ পর এর মধ্যে কেঁচো দিতে হবে। এই কেঁচোর মল থেকেই তৈরি হবে সার। কেঁচোও ওরই মধ্যে বংশ বৃদ্ধি করে। পরে কেঁচো ও সার আলাদা করে ফেলা হয়। কোনো রিংয়ে আড়াই শ গ্রাম কেঁচো দিলে ১৫ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে এক কেজি কেঁচো তৈরি হয়। প্রতি কেজি সার বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ টাকায়।
দিলীপ মিস্ত্রি পাড়ার ১৫ পরিবারের সব নারী সার উৎপাদন করছেন। উষা বালাদের পাশেই জান্নাতুল ফেরদৌসদের বাড়ি। পঁচিশোর্ধ্ব এই নারী তিন সন্তানের জননী। স্বামী মোহাম্মদ সুমন চা–বাগানে শ্রমিকের কাজ করে মাসে হাজার তিনেক টাকা পান। সংসারে অভাব লেগে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। জান্নাতুল জানালেন, বছর তিনেক আগে তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। শুরুতে তেমন সাড়া না মিললেও এখন দুই মাস পরপর ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি বিক্রি করছেন। সার বিক্রি করে তিনি ইতিমধ্যে ২টি ছাগল ও ১০টি মুরগি কিনেছেন।
জান্নাতুল ফেরদৌসের চাড়ি আছে ১৩টি। প্রতিটিতেই সার রাখা ছিল। একেকটিতে ৫০ কেজি করে সার রাখা যায়। জান্নাতুলের স্বামী মোহাম্মদ সুমন বললেন, কিছু টাকা জমিয়ে ও কিছু টাকা ঋণ নিয়ে তাঁরা ছয়টা গরু কিনেছিলেন। আগে গরুর গোবর ফেলে দিতেন। কিন্তু এখন এসব গোবর কাজে লাগাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। শুরুতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কেঁচো দেওয়া হয়েছিল। এরপর তাঁরা নিজেরাই কেঁচো উৎপাদন শুরু করেন।
এ পাড়ার বাসিন্দা ছালমা বেগম, লিপি দেবী, ওমা রানি শীল বললেন, আয় হয় এমন কোনো কাজে তাঁরা জড়িত ছিলেন না। স্বামীর একার আয়েই তাঁদের সংসার চলত। ২০২০ সালে উষা বালা তাঁদের পাড়ায় কেঁচো সার তৈরির কাজ শুরু করেন। উষা বালার দেখাদেখি তাঁরাও সার তৈরির কাজে নেমেছেন। এখন পরিবারের খরচ চালাচ্ছেন।
রাঙ্গাপানি গ্রামের আরেক বাসিন্দা রমা রানি দেবী কেঁচো সার বিক্রি করে সন্তানের জন্য সাইকেল কিনেছেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া তাঁর ছেলে সাত কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করে সাইকেলে চড়ে। এ ছাড়া সার বিক্রির টাকায় কিনেছেন হাঁস-মুরগি। স্বামীর খাবারের হোটেল খুলতেও সহযোগিতা করেন এই নারী। রমা রানি দেবী জানান, গত দুই বছরে ১ লাখ ১০ হাজার ৮০০ টাকা আয় করেছেন সার বিক্রি করে। বর্ষা মৌসুমে উৎপাদন কিছুটা কম হয়। তবে অন্য মৌসুমেই ভালো উৎপাদন হয়।
উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রাহুল ধর প্রথম আলোকে বলেন, কেঁচো সার উৎপাদনে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নিয়মিত তদারক করা হয়। কৃষকদেরও এই সার ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কৃষকেরা রাসায়নিক সারের বদলে কেঁচো সার প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছেন।
জমিতেও কেঁচো সার
রাঙ্গাপানি গ্রামে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েক কৃষকের সঙ্গে। মোহাম্মদ শাহেদ মিয়া, রতন শীল, মোহাম্মদ শাহিন জানালেন, তাঁরা জমিতে আগে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতেন। এই সার অতিরিক্ত ব্যবহারে মাটির উর্বরতা শক্তি ও পানি ধারণক্ষমতা কমে যায়। ফসলে রোগজীবাণুর আক্রমণও বেশি হয়। এ কারণে তিনি বছর চারেক আগে থেকে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে কেঁচো সার ব্যবহার করছেন। এতে খরচও কম হচ্ছে। তিনি নিজেও সার তৈরি করেন, গ্রামের নারীদের কাছ থেকে কিনেও নেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাঙ্গাপানি গ্রামে নারীদের সার উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ দেখতে গিয়েছিলেন। এই সার ব্যবহার করতে কৃষকদের উৎসাহ দিয়েছিলেন বলে জানান তিনি। ওমর ফারুক বলেন, কেঁচো সার উৎপাদনের এ উদ্যোগের মাধ্যমে নারীদের আত্মসামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে। আগে গোবর ফেলে দিতেন। এটি এখন কাজে লাগছে। আয় হচ্ছে। এই সার ব্যবহারে উপকার পাচ্ছেন কৃষকেরাও। মাটির গুণাগুণও বৃদ্ধি পাচ্ছে।