কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষার্থী বহিষ্কারের প্রক্রিয়াকে ‘স্বৈরাচারী’ বলছে বিভিন্ন পক্ষ, প্রশাসনের অস্বীকার
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন করায় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ারকে সাময়িক বহিষ্কারের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার অভিযোগ উঠেছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তবে কুমিল্লার বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা ওই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়াকে ‘স্বৈরাচারী’ বলছেন। তাঁদের দাবি, ওই শিক্ষার্থীকে আত্মপক্ষ সমর্থন বা কারণ দর্শানোর কোনো সুযোগ না দিয়েই হুট করে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
অন্যদিকে উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈন বলছেন, ‘প্রক্টরিয়াল বডির প্রাথমিক প্রতিবেদন ও সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তারা এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছি। তাঁকে তো আজীবনের জন্য বা স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়নি।’
মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। তিনি ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার আফজলনগর গ্রামে। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির অর্থ সম্পাদক।
আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। প্রতিবাদ ছাপাতে বলেনি। কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়নি।
গত ৩১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের এক অনুষ্ঠানে উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের দেওয়া বক্তব্য নিয়ে ‘দুর্নীতি হচ্ছে তাই বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে: কুবি উপাচার্য’ শীর্ষক শিরোনামে ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার অনলাইনে একটি প্রতিবেদন করেন মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ার। ওই প্রতিবেদনের জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্নের অভিযোগ তুলে ইকবাল মনোয়ারকে গতকাল বুধবার এক অফিস আদেশে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
জানতে চাইলে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাইয়িদ মাহমুদ পারভেজ বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে ওই শিক্ষার্থী সাংবাদিককে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে। তাঁর বহিষ্কারাদেশ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হত্যার শামিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে যে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে, সেটা সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী মনোভাব। কারণ, কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ধাপগুলো অতিক্রম না করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা ছাড়া সংবাদ প্রকাশ বা মতপ্রকাশ কখনো শৃঙ্খলা ভঙ্গের পর্যায়ে পড়ে না। তিনি ওই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাই শৃঙ্খলা ভঙ্গ। প্রক্টরিয়াল বডির ওপর অর্পিত ক্ষমতা মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, কোনো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করলে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইনে প্রক্টরিয়াল বডি আনতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাই শৃঙ্খলা ভঙ্গ। প্রক্টরিয়াল বডির ওপর অর্পিত ক্ষমতা মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তবে ইকবাল মনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। প্রতিবাদ ছাপাতে বলেনি। কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়নি।’
গত ৩১ জুলাই উপাচার্যকে উদ্ধৃত করে ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অনেকেই বলে দেশে দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন হচ্ছে না। কিন্তু আমি বলব উল্টো কথা। দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে। এটা নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন কথা বলতে পারে। যে ঘুষ খায়, সে পদ্মাপাড়ে যায় ইলিশ খেতে। এতে পদ্মাপাড়ের গরিব মানুষেরা ধনী হচ্ছে। দুর্নীতি এভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখে। তাই অর্থনীতিবিদগণ দুর্নীতি নিয়ে কখনো কোনো বিরূপ মন্তব্য করে না। তবে যারা পলিটিক্যাল ইকোনমি নিয়ে কাজ করে, তারা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে থাকে। নৈতিকতার জায়গায়ও এটি প্রশ্নবিদ্ধ। তবে অর্থনীতির জায়গা থেকে যদি বলি, দুর্নীতি কখনোই উন্নয়নের জন্য বাধা নয়।’
এ ঘটনার পর ওই শিক্ষার্থী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে উপাচার্যের বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ ওঠে। যদিও ওই শিক্ষার্থী দাবি করেছেন, তিনি উপাচার্যের বক্তব্য হুবহু উদ্ধৃত করে প্রতিবেদন করেছেন। তাঁর কাছে ওই বক্তব্যের অডিও রেকর্ড ও তথ্য–প্রমাণ আছে।
পরে গতকাল রাত আটটায় এক অফিস আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ইকবাল মনোয়ারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। এর প্রতিবাদে আজ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি। এ ছাড়া উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
জানতে পাইলে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি রোকেয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, কারণ দর্শানোর নোটিশ বা কৈফিয়ত তলব করতে পারত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। হুট করে সাময়িক বহিষ্কার সিদ্ধান্ত নেওয়া যুক্তিযুক্ত হয়নি বলে তিনি মনে করেন।