কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে এবার ভোটযুদ্ধে নেমেছেন ৯ জন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার। তিনি এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির স্ত্রী। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাহীন আক্তারের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির তাহা ইয়াহিয়া। তাঁকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। তবে এবার শাহীন আক্তারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন দলের দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাঁরা হলেন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নুরুল বশর ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল আহমদ। দুজনই শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
সোহেল আহমদের বাবা নুর আহমদ পাকিস্তান আমলে জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) ছিলেন। প্রবীণ রাজনীতি ও আইনজীবী হিসেবে টেকনাফে তাঁর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় টেকনাফে প্রথম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়েছিল আহমদের ঘরে। অন্যদিকে নুরুল বশরের ছোট ভাই নুরুল আলম বর্তমানে টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। তিনি টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন।
নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শাহীন আক্তারের বিরুদ্ধে দলের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের অভিযোগ, ক্ষমতার পাঁচ বছরে তিনি দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেননি। সরকারি-বেসরকারি কোনো সভা-সমাবেশেও তিনি ছিলেন অনুপস্থিত। শাহীন আক্তারের পুরো কাজ সামলাচ্ছেন তাঁর স্বামী আবদুর রহমান বদি। দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় আবদুর রহমান বদিকে গত দুবার দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
একই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটারদের নজর কাড়ছেন মোহাম্মদ ইসহাক (৩০) নামের এক তরুণ। তিনি আবদুর রহমান বদিকে নিজের জন্মদাতা বাবা দাবি করছেন। সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে তিনি নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছেন বলে জানান।
এ ছাড়া এ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরও পাঁচ প্রার্থী। তাঁরা হলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুরুল আমিন সিকদার, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদ আলম, তৃণমূল বিএনপির মুজিবুল হক, ইসলামী ঐক্যজোটের মোহাম্মদ ওসমান গনি ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. ইসমাইল।
গত ৩০ নভেম্বর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানের কাছে সবাই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তফসিল অনুযায়ী ১-৪ ডিসেম্বর মনোনয়ন বাছাই, ১৭ ডিসেম্বর প্রত্যাহার, ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ এবং ৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
শাহীন-বদির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
আজ শনিবার দুপুরে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের গোদারবিল গ্রামের একটি চায়ের দোকানে নির্বাচন নিয়ে আড্ডায় বসেন স্থানীয় ১০-১২ জন ভোটার। তাঁদের একজন কবির আহমদ। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি পান চাষ করে সংসার চালাচ্ছেন। সংসারে স্ত্রী, চার ছেলে ও তিন মেয়ে।
কবির আহমদ (৬০) প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নৌকার ঘোর সমর্থক। গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নৌকায় ভোট দিয়েছেন। এবারও নৌকায় ভোট দেওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে পানচাষি কবির আহমদ বলেন, তবে শাহীন আক্তারকে নয়, নতুন কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবেন তিনি।
কারণ জানতে চাইলে কবির আহমদ বলেন, গত পাঁচ বছরে শাহীন আক্তারকে তিনি চোখে দেখেননি। শাহীনকে ঘরে বন্দী রেখে পুরো ক্ষমতা ভোগ করছেন তাঁর স্বামী বদি। বদিকেও দুবার ভোট দিয়েছিলেন তিনি। এলাকায় শিক্ষার প্রসার, রাস্তাঘাটের উন্নয়নে স্বামী-স্ত্রী দুজনের তেমন ভূমিকা নেই। প্রতিনিয়ত শত শত গরিব লোকজনকে চাল, তেল, নগদ টাকা তুলে দিয়ে ভিক্ষুক বানাচ্ছেন। টেকনাফে মাদকের কারবার বেড়েছে অনেক। টেকনাফকে মাদকমুক্ত করতে পারবেন—এমন প্রার্থী খুঁজছেন ভোটারেরা।
টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতা-কর্মীদের মধ্যেও শাহীন-বদির বিরুদ্ধে ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা গেছে। শাহীন আক্তার নামেই সংসদ সদস্য—দাবি করে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে শাহীন আক্তারকে আমরা চোখে দেখিনি। দলীয় এবং রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মসূচিতে তাঁকে পাওয়া যায় না। শাহীন আক্তারের দাপ্তরিক কাগজপত্রে (সরকারি নথিপত্রের) স্বাক্ষর করেন স্বামী। গত পাঁচ বছরে শাহীন আক্তারকে উপজেলা পরিষদের মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটি ও মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় দেখা যায়নি।’
দলের নেতারা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাহীন আক্তারের বিরুদ্ধে মাঠে ছিল দুর্বল প্রার্থী। এ কারণে খালি মাঠে সহজ জয় পেয়েছেন তিনি। এবার জয় পেতে হলে কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। বিশেষ করে দলের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। কারণ, টেকনাফ-উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী এই দুই প্রার্থীর পক্ষে রয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী যুদ্ধে লড়ে যাবেন জানিয়ে তরুণ প্রার্থী সোহেল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, টেকনাফ উখিয়াকে মাদকমুক্ত দেখতে চান এলাকার মানুষ। শিক্ষা ও যোগাযোগব্যবস্থারও পরিবর্তন চান মানুষ। সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় রোহিঙ্গা–সংকটের কারণে সৃষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় লোকজনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। এলাকায় পরিবেশ-পরিস্থিতিও খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি প্রার্থী হয়েছেন। ভোটাররাও তাঁর পক্ষে আছেন।
দলের অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল বশর বলেন, টেকনাফ স্থলবন্দরসহ এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা বদির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সাধারণ মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন না। টেকনাফে মাদক চোরাচালান, হুন্ডি ব্যবসা আগের তুলনায় বেড়েছে শত গুণ। মাঝে ক্রসফায়ারে মারা হলো টেকনাফের দেড় শতাধিক মানুষকে। এর নেপথ্য কারণও ভোটারদের জানা আছে।
দলের দুই প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকলে শাহীন–বদির বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী দুই প্রার্থীই জনপ্রিয়। ভোট ভাগ হলেও তাঁরা দুজন শাহীন আক্তারের চেয়ে বেশি ভোট পাবেন।
উল্লেখ্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বদির নাম রয়েছে। এই তালিকায় বদির চার ভাইসহ পরিবারের অন্তত ২৬ জনের নাম রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বদির ভাষ্য, তালিকায় নাম থাকলেও তিনি মাদক ব্যবসায় জড়িত, কিংবা মাদক ব্যবসায়ী থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন—এমন প্রমাণ কারও হাতে নেই।
স্ত্রীর প্রসঙ্গে আবদুর রহমান বদি বলেন, তিনি দলের প্রার্থী, মনোনয়ন দিয়েছেন শেখ হাসিনা। সুতরাং নৌকার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ নেই কারও। শাহীন আক্তার সব সময় এলাকায় থাকেন। তাঁর আশা, এবারও তিনি বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন।