ক্ষমতার দাপট—৪
বড় ঠিকাদারি সব তাঁর কবজায়
গত পাঁচ বছরে জেলার অন্তত ৩১টি ঠিকাদারি কাজ নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে বাগিয়ে নিয়েছেন খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান।
প্রভাব খাটিয়ে নিজ সংসদীয় এলাকায় একের পর এক প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। দিনের পর দিন সেই কাজ ফেলে রাখার, নিম্নমানের কাজ করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিশেষ করে তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের করা বেড়িবাঁধের কাজে নয়ছয়ের অভিযোগ বেশ পুরোনো। এ কারণে সাধারণ মানুষসহ দলের নেতা–কর্মীরা অনেকে ক্ষিপ্ত তাঁর ওপর। তিনি খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান।
২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কয়রায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গেলে ক্ষুব্ধ মানুষজন তাঁকে দেখে কাদা ছুড়ে ধাওয়া করেছিলেন। গত ২৩ আগস্ট শোক দিবসের এক সভায় তাঁকে অপদস্থ করে বসেন আওয়ামী লীগের এক নেতা। আক্তারুজ্জামানের বক্তৃতা চলাকালে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মোহসীন রেজা বলে ওঠেন, ‘এখানে উসকানিমূলক বক্তব্য দেবেন না। আপনি আর দলের বারোটা বাজাবেন না।’
আক্তারুজ্জামান একসময় খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেখান থেকে হন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তারপর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পান। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে পান নৌকার টিকিট। সেবার বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ও কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’
নামে-বেনামে ঠিকাদারি কাজ
আক্তারুজ্জামান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) খুলনা জেলা ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি। ‘মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজ’ নামে তাঁর একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স রয়েছে। একাধিক স্থানীয় ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজের ঠিকাদারি লাইসেন্স দিয়ে ও অন্যের লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে সংসদীয় এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ৩১টি কাজ করেছেন সংসদ সদস্য।
জেলার পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলা উপকূলীয় এলাকা হিসেবে পরিচিত। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়ঝঞ্ঝায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই এলাকার বেড়িবাঁধ। কোথাও বাঁধ ভেঙে গেলে তা তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করতে হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো)। ওই কাজকে বলা হয় আপত্কালীন বা জরুরি কাজ (ডিপিএম)। এ ধরনের কাজের জন্য কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয় না। অভিযোগ রয়েছে, কয়রা ও পাইকগাছার এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন আক্তারুজ্জামান। তিনি নিজে ওই কাজ করেন। আর অন্য কোনো ঠিকাদারকে ওই কাজ করতে গেলে কাজ শুরুর আগে মূল কাজের ১০ শতাংশ টাকা দিতে হয় আক্তারুজ্জামানকে। বর্তমানে চাকরিরত ও বদলি হয়ে যাওয়া পাউবোর অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
গত পাঁচ বছরে শুধু তাঁর সংসদীয় এলাকাতেই নিজের ঠিকাদারি লাইসেন্স দিয়ে ৯টি বড় প্রকল্পের কাজ করার তথ্য পেয়েছে প্রথম আলো। অন্য ঠিকাদারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন ও করছেন এমন কাজের সংখ্যা প্রায় ১০। এ ছাড়া খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় আরও অন্তত ছয়টি প্রকল্পের কাজ করছেন নিজের ঠিকাদারি লাইসেন্স দিয়ে। এর বাইরে অন্যের ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে পাইকগাছা ও কয়রা—দুই উপজেলায় আরও অন্তত ছয়টি কাজ করছেন আক্তারুজ্জামান। এ ক্ষেত্রে তিনি ‘মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্স’ নামের একটি লাইসেন্স ব্যবহার করছেন। মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্সের মালিক মো. জিয়াউল আহসান স্বীকার করেছেন, সংসদ সদস্য তাঁর লাইসেন্স ব্যবহার করে ঠিকাদারি কাজ করছেন। জিয়াউল খুলনা সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।
প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমপির তদবির থাকে। তাঁর কথা না শুনলে জামায়াত-শিবিরের লোক হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।
খুলনা বিভাগীয় পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চৌমুহনী বাজার পর্যন্ত সড়কের মাঝের প্রায় দুই কিলোমিটার পাকা সড়ক করার কাজ পেয়েছে আক্তারুজ্জামানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজ। ওই কাজের চুক্তিমূল্য ২ কোটি ১৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। গত বছরের ৫ মে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করেন সংসদ সদস্য। চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের ২০ মার্চের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলেও মেয়াদ বাড়ানোর জন্য তিনি কোনো আবেদন করেননি। সর্বশেষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর ওই কাজ কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে ওই ঠিকাদারকে চূড়ান্ত নোটিশ দেন এলজিইডি খুলনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আনিছুজ্জামান। ওই নোটিশের কোনো জবাব দেননি, কাজও শুরু করেননি ঠিকাদার।
পাইকগাছা উপজেলার লতা ইউনিয়নের হাড়িয়া সেতুর পাশ দিয়ে উত্তর দিকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত চলে গেছে একটি সড়ক। সড়কটি ছিল ইটের সোলিংয়ের। সড়কটি পাকা করার কাজ পেয়েছে মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজ। ওই প্রকল্পের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ২ কোটি ৫২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৪২ টাকা। কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২২ সালের ৬ অক্টোবর। চলতি বছরের ৫ অক্টোবর কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ।
গত ২২ অক্টোবর ওই সড়কে দেখা যায়, কোনো যানবাহনই সেখান দিয়ে চলাচল করতে পারে না। হেঁটে যাওয়াও দুষ্কর। গত সেপ্টেম্বর মাসে সড়কের ওপর ধানগাছ লাগিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন আন্ধারমানিকের লোকজন।
পাইকগাছা উপজেলার প্রকৌশল দপ্তরের গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজের নামে চলা কাজগুলোর অধিকাংশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বেশ আগে। কিন্তু কাজ হয়েছে ১০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত।
কয়রার কাজেও গড়িমসি
কয়রা উপজেলার হড্ডা ডিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নতুন পাঁচতলা ভবন নির্মাণে যৌথভাবে কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্স ও মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজ। ৪ কোটি ১২ লাখ টাকার ওই প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৯ সালের আগস্টে। দেড় বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ।
অন্যদিকে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণকাজের ঠিকাদার মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্স। ৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যের ওই প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, গত এক বছরে কেবল পাইলিংয়ের কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মূলত জিয়াউল ট্রেডার্সের লাইসেন্স নিয়ে কাজ দুটি করছেন সংসদ সদস্য। সে কথা স্বীকার করেছেন মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্সের মালিক মো. জিয়াউল আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান তাঁর (জিয়াউল) লাইসেন্স নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঠিকাদারি কাজ করছেন। এ কারণে ওই কাজের সর্বশেষ অগ্রগতি তাঁর জানা নেই।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম জানান, গত ৩০ জুনের মধ্যে ভবনের নির্মাণকাজ শেষে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজের অগ্রগতি দেখে মনে হচ্ছে আগামী দুই বছরেও তা শেষ হবে না। তিনি বলেন, ‘ভবনের কারণে স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হওয়ায় আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারবার তাগিদ দিচ্ছি। কিন্তু কাজের মূল ঠিকাদার বিষয়টি গুরুত্ব দেননি।’
কয়রা উপজেলার আমাদি ইউনিয়ন ও সদর ইউনিয়নের প্রায় তিন কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নকাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজ। কাজ দুটির চুক্তিমূল্য ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। গত বছরের মার্চে কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের মার্চে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৫০ শতাংশ।
কয়রার সাবেক এক ইউএনও বলেন, ‘প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমপির তদবির থাকে। তাঁর কথা না শুনলে জামায়াত-শিবিরের লোক হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। তবে আমি ভিন্ন ধর্মের হওয়ায় আমাকে ওই তকমা দিতে পারেননি। পরিবর্তে এমপির ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে অনেক।’