নৌকার টানে সিলেটের বাইশটিলায়
সিলেট শহরতলির সবুজ-শ্যামল বাইশটিলা গ্রাম। পাশেই উফতা বিল আর বাওড়কান্দি হাওর। গ্রামের নাক–বরাবর বয়ে গেছে চেঙ্গেরখাল নদী। ভরা বর্ষায় নদী, বিল ও হাওর পানিতে টইটম্বুর থাকে। তখন এখানে নৌকা ভাসিয়ে মনের আনন্দে শহুরে মানুষ প্রকৃতির বুকে হারান।
দিনপঞ্জির হিসাবে বর্ষাকাল আরও আগে বিদায় নিয়েছে। তবু খাল–বিল, হাওর–বাঁওড় এখনো পানিতে টইটম্বুর। নৌকা ভ্রমণে ছুটে আসছেন মানুষ। এসব দর্শনার্থীকে নিয়ে নৌকার মাঝিরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান। রংবেরঙের ঝালর-আচ্ছাদিত নৌকা পানিতে ভেসে চলার অপূর্ব দৃশ্য দেখতেও অনেকে জড়ো হচ্ছেন বিল, হাওর ও নদীর পাড়ে।
৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকেলে দেখা যায়, বর্ষার কারণে বিল ও হাওরের পানি সেখানে মিলেমিশে একাকার। একইভাবে নদীও মিশেছে হাওরের সঙ্গে। মাঝিদের সঙ্গে দরদাম করে নৌকায় চেপে বসছেন মানুষজন। পাড়ে বসে কয়েক শ মানুষ চটপটি, ফুচকাসহ মুখরোচক নানা খাবার খাচ্ছেন। একটু দূরে গ্রামের সামনের রাস্তা ঘেঁষে প্রায় ৩০ জন বিক্রেতা হাওরের তাজা মাছের পসরা বসিয়েছেন। নৌভ্রমণ শেষে মানুষ সেসব মাছ কিনে বাড়ি ফিরছেন।
সপরিবার নৌভ্রমণে এসেছিলেন সিলেট নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা চল্লিধোর্ধ্ব ফাহিম আহমদ। বেসরকারি এই চাকরিজীবী বলেন, ‘আমি হাওরাঞ্চলের ছেলে। তাই নৌভ্রমণ আমার কাছে স্বাভাবিক বিষয়; কিন্তু আমার স্ত্রী শহরে বেড়ে উঠেছে। আট বছরের ছেলেও কখনো নৌকায় চড়েনি। তাদের নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দিতেই এখানে এসেছি। দারুণ একটি বিকেল কাটল। এখন চটপটি-ফুচকা খেয়ে বাসায় ফিরব।’
একাধিক দর্শনার্থী আর মাঝির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, ছুটির দিনে বিশেষত শুক্র ও শনিবার বিপুলসংখ্যক মানুষ আসেন এখানে। ওই দুই দিন একেকটা নৌকাকে ঘণ্টাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দিতে হয়। অবশ্য দরদাম করে কিছুটা কমানোও যায়। অন্যান্য দিন আরও কমে নৌকা পাওয়া যায়। নৌকায় সর্বোচ্চ ৮-১০ জন বসা যায়। দল বেঁধে আসা মানুষ কিংবা পরিবারের সদস্যরা কেবল নিজেদের জন্যই নৌকা ভাড়ায় নেন।
বাইশটিলা গ্রামের বাসিন্দা শহিদ মিয়ার (৪৫) একটি নৌকা আছে। তিনি জানান, অন্তত ১০০ নৌকা এখানে ভাড়ায় চলে। ছুটির দিনে গড়ে ৬০০ লোক আসেন। প্রায় পাঁচ বছর আগে এখানে নৌভ্রমণের আয়োজন চালু হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বাইশটিলা এলাকাটি স্থানীয় পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পায়। এখন বর্ষা মৌসুমে এটি জমজমাট পর্যটনকেন্দ্র।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকেরা জানান, সিলেট নগরের আম্বরখানা এলাকা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে সহজেই বাইশটিলা এলাকায় আসা যায়। এ জন্য অটোরিকশা চালকদের ১৫০-২০০ টাকা দিতে হয়। অথবা শহরের যেকোনো স্থান থেকে অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে বাইশটিলায় আসা যায়। সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে বাইশটিলা এলাকার দূরত্ব প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার।
নৌভ্রমণের পাশাপাশি পাড়ে বসে মুখরোচক নানা খাবারও খাওয়া যায়। অনেকে নৌকায় না চড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে বসে খাওয়াদাওয়া আর আড্ডার জন্যও এখানে আসেন। দোকানিরা জানান, ঠান্ডা পানীয়, চা-কফির পাশাপাশি চটপটি, ফুচকা, শিঙাড়া, পেঁয়াজু, ছোলা, চপ, বার্গার, ঝালমুড়ি, আমড়া, আচারসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার পাওয়া যায় এখানে। প্রতি প্লেট চটপটি ৩০-৪০ টাকা এবং ফুচকা ৫০-৬০ টাকায় পাওয়া যায়। প্রতিটি শিঙাড়া ৭ টাকা এবং চপ ও পেঁয়াজু ৫ টাকায় পাওয়া যায়।
সন্ধ্যা হওয়ার মুহূর্তে মানুষ ফিরতে শুরু করেন বাইশটিলা থেকে। অনেকে একমুহূর্তের জন্য ঢুঁ মারেন রাস্তার পাশের অস্থায়ী মাছবাজারে। নগরের চৌকিদেখী এলাকার বাসিন্দা মুহিবুর রহমান বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নৌকা ভ্রমণে এসেছিলাম। এখন ফেরার পথে মাছ কিনে নিলাম। দেশি জাতের অন্তত ১৫-২০ প্রজাতির তাজা মাছ এখানে পাওয়া যাচ্ছে। মাছগুলো লাফাচ্ছে। কিছু টেংরা, রানি ও পুঁটি এবং একটি বড় আকারের কালিয়া মাছ কিনে নিলাম।’