২০ বছরের আইনি লড়াই শেষে শিক্ষক দম্পতির জয়
বিদ্যালয়ের আয়ার বেতন বন্ধের প্রতিবাদ করার জেরে ২০ বছর আগে প্রধান শিক্ষক সাইয়েদুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সহকারী শিক্ষক মাসুমা আক্তারকে বরখাস্ত করেছিল ব্যবস্থাপনা কমিটি। এরপর শুরু হয় ওই দম্পতির সংগ্রামের জীবন। ব্যবস্থাপনা কমিটির আদেশের বিরুদ্ধে করা মামলার খরচ জোগানোর পাশাপাশি সংসারের খরচ ও পাঁচ সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁদের। তবে হার মানেননি ওই দম্পতি। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন তাঁরা।
সাইয়েদুর রহমান পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার খাতুন্নেছা স্মৃতি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁর স্ত্রী মাসুমা আক্তার একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। গত বৃহস্পতিবার দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে উচ্চ আদালতের রায়ে তাঁরা বিদ্যালয়ে স্বপদে ফিরেছেন। এ সময় শিক্ষক দম্পতিকে পুষ্পমাল্য দিয়ে বরণ করে ব্যবস্থাপনা কমিটি, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
প্রধান শিক্ষক সাইয়েদুর রহমান বলেন, ‘আমাকে ও আমার স্ত্রীকে বিধি লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে বরখাস্ত করেছিল বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটি। ২০ বছর আইনি লড়াই করে বরখাস্তের আদেশ অবৈধ প্রমাণ করে চাকরির শেষ বেলাতে স্বপদে ফিরে এসেছি। আর ৯ মাস পর আমি অবসরে যাব। আমরা স্বামী–স্ত্রী চাকরি হারিয়ে দীর্ঘ সময় মানবেতর জীবন যাপন করেছি। প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালিয়েছি। পাঁচ সন্তানকে কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছি। বড় ছেলে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অন্য চার সন্তান পড়াশোনা করছে।’
তবে সায়েদুর রহমান আত্মবিশ্বাসী মানুষ। জানতেন, একদিন জয়ী হবেন। মামলা চলাকালে প্রতিপক্ষের লোকজন পিরোজপুর ও বাগেরহাট আদালতে বিভিন্ন সময়ে সাইয়েদুর রহমানকে গাছ কাটা, ধান চুরিসহ একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। কিন্তু ওই সব মামলা খারিজ হয়ে গেছে। সাইয়েদুর রহমান বলেন, ‘আমি কখনো হাল ছাড়িনি। কখনো ক্লান্ত হয়নি। তাই আজ জয়ী হতে পেরেছি।’
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চরখালী গ্রামে জার্মানপ্রবাসী আনসার উদ্দিন মল্লিক খাতুন্নেছা স্মৃতি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালে সাইয়েদুর রহমান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এর দুই বছর আগে তাঁর স্ত্রী মাসুমা আক্তার ওই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০১ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি নাসরিন মল্লিকের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে ২০০২ সালের ২৬ জুন তৎকালীন অ্যাডহক কমিটি প্রধান শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রীকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
ওই বছরের ১৪ জুলাই সাইয়েদুর বরখাস্তের আদেশের বিরুদ্ধে সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন। মামলা চলাকালে ২০০৪ সালে সাইয়েদুরকে এবং ২০০৫ সালে মাসুমা আক্তারকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করে ব্যবস্থাপনা কমিটি। ২০০৭ সালের ২৯ নভেম্বর সহকারী জজ আদালত সাইয়েদুর রহমান ও মাসুমা আক্তারের বরখাস্তের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে আদেশ দেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নাসরিন মল্লিক পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল আপিল খারিজ করে নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত।
এরপর বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অমল কৃষ্ণ হালদার হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১১ সালের ৩১ মে তা খারিজ হয়ে যায়। এরপর তিনি সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ মামলা করেন। গত ৪ আগস্ট প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রিভিউ মামলাটিও খরিজ করে দেন। ৭ সেপ্টেম্বর সাইয়েদুর রহমান বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে বিদ্যালয়ে স্বপদে পুনর্বহালের আবেদন করেন। গত মঙ্গলবার বোর্ড কর্তৃপক্ষ সাইয়েদুর রহমান ও মাসুমা আক্তারকে পুনর্বহালের নির্দেশ দেন। এরপর তাঁরা বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
জানতে চাইলে সাইয়েদুর রহমান জানান, ২০০২ সালের মার্চে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আনসার উদ্দিন মল্লিকের স্ত্রী নাসরিন মল্লিকের বাড়িতে বিদ্যালয়ের আয়া ডালিম বেগম কাজ না করায় তাঁর বেতন আটকে দেওয়া হয়। এ সময় ডালিম বেগমের পক্ষ নেওয়ায় নাসরিন বেগমের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। এর জের ধরে ২০০২ সালে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ওই সময়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হরি প্রসাদ পালকে দিয়ে সাইয়েদুর ও তাঁর স্ত্রী মাসুমা আক্তারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সহকারী শিক্ষক মাসুমা আক্তার বলেন, ‘আয়ার বেতন বন্ধ নিয়ে বিরোধের জের ধরে অন্যায়ভাবে আমাদের বরখাস্ত করা হয়েছিল। আটটি অভিযোগ আনা হয়েছিল প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অভিযোগগুলো আদালতে অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়। ২০টি বছর আমাদের জীবনে কত ঝড় বয়ে গেছে, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। সংসারের ব্যয়, মামলার খরচ চালানো ও ছেলে মেয়ের পড়াশোনা করাতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।’
নাসরিন মল্লিক বর্তমানে এলাকায় না থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মজিবুর রহমান আকন বলেন, ‘অন্যায়ভাবে প্রধান শিক্ষক সাইয়েদুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সহকারী শিক্ষক মাসুমা আক্তারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাঁরা আদালতের রায় এবং বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে বিদ্যালয়ে স্বপদে পুনর্বহাল হয়েছেন। আমরা তাঁদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছি।’