উৎসবের দিনে মাগুরছড়ায় খাসিয়াদের গ্রামে
‘অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে/ সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু’—পথে যেতে যেতে শুয়ে থাকা ফসলের মাঠ দেখে এমনটাই মনে পড়েছে। সড়কের দুই পাশে আমনের মাঠ কোথাও হলুদ, সোনালি হয়ে আছে। তাতে ঝলমল করছে রোদের আনন্দ।
মৌলভীবাজার শহর থেকে শমসেরনগর সড়ক ধরে কমলগঞ্জ যাওয়ার পথে হেমন্তের মাঠ এ রকমই বুকভরা আমন ধানের সোনা রং নিয়ে উজ্জ্বল হয়েছিল। হেমন্ত এ রকমই হয়, ‘পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ’।
তবে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কের কমলগঞ্জের ভানুগাছ থেকে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে ওই সব রূপশালি ধানের সঙ্গে আরও অনেক কিছুর যোগ হতে থাকে। সড়কের দুই পাশজুড়ে অর্জুনগাছের সারি। ওই পথে বটতলা আছে, হীড এলাকা আছে। এরপর ফুলবাড়ি চা-বাগান। এভাবেই একসময় লাউয়াছড়া বনের দিকে ঢুকে গেছে সড়ক। দুই পাশে উঁচু টিলা, গাছের সারি, গুল্মলতার ঝোপ। ঝিঁঝি পোকার ডাক। ছায়ায় নরম হিম। আর ওখানেই পাহাড়ি টিলায় ছোট নিরিবিলি, নিভৃত একটি ঠিকানা, নাম ‘মাগুরছড়া পুঞ্জি’। ওই গ্রামে খাসিয়াদের (খাসি) বাস। অনেক বছর ধরে তাঁরা ওখানে বাস করছেন। খাসিয়া পানের চাষ করে চলছেন। তাঁদের জীবিকার প্রধান খাত এই খাসিয়া পান চাষ। পানের উৎপাদন ও দাম ভালো হলে জীবন ভালো চলে। না হলে দুঃখ-কষ্টে পড়তে হয় অনেককে।
২৩ নভেম্বর ছিল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী খাসি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান ‘খাসি সেং কুটস্নেম’। ঢাকা-সিলেট রেললাইন অতিক্রম করে মাগুরছড়া পুঞ্জির দিকে ঢুকতেই সেই উৎসবের বাদ্য টুংটাং করে বেজে ওঠে। অনেক রঙিন মানুষ মাগুরছড়া পুঞ্জির মাঠের দিকে ছুটছেন। এরা বিভিন্ন পুঞ্জি থেকে উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন। এসেছেন অনেক বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষ। সবাই মিলেমিশে মাঠ ঘিরে মেলার মতো একটা সপ্রাণ, অনুচ্চ হইচইয়ে হাসিখুশির সমাবেশ। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে নারী-পুরুষ অনেকেই এসেছেন। নাচ-গানে অংশ নেবেন—এমন সাজে এসেছেন তরুণীরা। এই পাহাড়ঘেরা গ্রামে এটুকুই হইহুল্লোড়। নতুবা গ্রামটি চুপচাপ, শান্তই থাকে। কিছু পাখির ডাক ছাড়া মনেই হয় না, এখানে ৬০টি পরিবারের প্রায় ৩০০ মানুষ তাঁদের মতো করে জীবনের গান গেয়ে চলেছেন। মাঠে তখন বেশ কিছু ভ্রাম্যমাণ দোকান নানা পসরা নিয়ে বসেছে। বেশির ভাগ দোকানই নানা খাদ্য ও পণ্য দিয়ে সাজানো। এসবের প্রায় সব কটিরই নাম অচেনা। এসব অচেনা খাদ্য ও পণ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের প্রচার সম্পাদক সাজু মারচিয়াং।
এসব খাদ্যের মধ্যে ছিল একধরনের পিঠা। খাসি ভাষায় যার নাম ‘তউ তংকং’। ‘তউ’ হচ্ছে পিঠা, আর ‘তংকং’ হচ্ছে মাচা। এক প্রকার মাচার মধ্যে রেখে পাতায় মোড়ানো চালের গুঁড়ি ও গুড়ের তৈরি এই পিঠা গরম পানির ভাপে সিদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাই এমন নামকরণ। দুপুরে ‘লবণ পাতায়’ মোড়ানো যে খাবার পরিবেশন করা হলো সবার মধ্যে, তার নাম ‘জা ড’। জা ডের অর্থ হচ্ছে ভাত-মাংস। ‘জা’ ভাত, আর ‘ড’ মাংস। এই লবণ পাতা টিলার ভাঁজে ভাঁজে অনেক দেখা গেছে। একসময় এই পাতায় বেঁধে লবণ বিক্রি হতো বলে পাতাটির নাম লবণ পাতাই হয়ে আছে। হাটে গুড়সহ আরও অনেক খুচরা জিনিস এই পাতায় মুড়ে বিক্রি হয়েছে। এটি কোনো কিছু বেঁধে বিক্রি করার একটি পরিবেশবান্ধব উপকরণ। দোকানগুলোর মধ্যে ব্যবহারের অনেকগুলো পণ্য ছিল, তার মধ্যে ঝুড়ি একটি। গাছে ওঠে পান কাটতে গেলে পেছনে ঝুলিয়ে দাসহ অন্য সরঞ্জাম রাখতে সুবিধা এই ঝুড়িতে। এর নাম হচ্ছে ‘ছট’। কাপড়সহ আরও অনেক জিনিস ছিল মেলায়। দুপুরের খাবার খেয়ে হাত ধুয়ার ব্যবস্থাটিও ছিল চমক দেওয়া। একটা বাঁশের ভেতরটা ফাঁকা করে তার মধ্যে অনেকগুলো ছিদ্র করা হয়েছে। বাঁশের একপ্রান্তে পানির পাইপের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। তাতে অনেকজন একসঙ্গে হাত ধোয়ার কাজ, প্রয়োজনীয় ধোয়ামোছার কাজ সারতে পারেন।
‘খাসি সেং কুটস্নেম’—এটা উৎসবের দিন হলেও জীবিকার বিষয়টিকে তারা ভুলে যাননি। সমবেত সব পুঞ্জির মান্ত্রী ও প্রতিনিধিরা মাগুরছড়াতে সেমিনারের মতো এক আয়োজনে বসেছিলেন। এ বছর পানের ভালো দাম মিলেনি। অনেক পানচাষিরই কষ্টে দিন চলছে। এই একমুখী ফসল (খাসিয়া পান) উৎপাদন থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু করা নিয়ে সবাই আলাপ করেছেন। পানের সঙ্গে কফি চাষ করা যায় কি না, বিষয়টি নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে। পানের সাথি ফসল হতে পারে কফি চাষ। এটাকে নতুন সম্ভাবনা হিসেবেই দেখছেন খাসিয়াদের অনেকে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বেশির ভাগ গ্রামই অনেকটা দুর্গম স্থানে, বনের অনেক ভেতরে। এ ক্ষেত্রে মাগুরছড়া আলাদা, একদম পাকা সড়কের পাশে। একটা রেললাইন পার হলেই চোখের সামনে গ্রাম। আছে সুপারিসহ নানা রকম গাছ, কিছু গাছ জড়িয়ে আছে পানের লতা-পাতা। পাকা সিঁড়ি বেয়ে টিলার ওপরে গেলে এদিক-ওদিক বসবাসের ঘর। এসব ঘরে একরকম শান্ত, সৌম্য পরিবেশ। ঘরের মানুষগুলোও সে রকম, সরল-সহজ। অনেকটা নিঃশব্দ-নীরবে প্রবাহিত তাঁদের জীবনযাপন, তাঁদের সংস্কৃতি।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও মাগুরছড়া পুঞ্জির মান্ত্রী (সমাজপ্রধান) জিডিশন প্রধান সুচিয়াং প্রথম আলোকে বলেন, মাগুরছড়া পুঞ্জিতে প্রচুর পর্যটক আসতে চান। অনেকে আসেন, ঘোরেন। কিন্তু এতে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না। একটা স্থান নির্ধারণ করে পর্যটক এলাকা তৈরি করা যেত। যেখানে ফুড কর্নারে খাসিয়াদের খাবার, পোশাক-আশাক, অন্যান্য সরঞ্জাম প্রদর্শন করতে পারলে ভালো হতো। জাদুঘর করা যায়, যেখানে তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হবে। পর্যটনের পাশাপাশি কিছু পরিবারের কর্মসংস্থানও হতো।