পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও মাটির গুণাগুণের মারাত্মক ক্ষতির বিষয়টি জেনেও তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন রংপুরের কৃষকেরা। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরও জেলায় তামাকের আবাদ বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তামাক চাষ করায় নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কৃষি বিভাগের উদাসীনতা, তামাক উৎপাদনের আগে কোম্পানিগুলোর দর নির্ধারণ, বিক্রির নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ দান—তামাক চাষ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। এমন অবস্থায় আজ ৩১ মে (শুক্রবার) পালিত হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর জেলায় এবারে ১ হাজার ৮৪০ হেক্টরে তামাকের চাষ হয়েছিল। গত বছর চাষ হয়েছিল ১ হাজার ৫০০ হেক্টরে। জেলায় এবারে সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয়েছে তারাগঞ্জ উপজেলায় ৯৬০ হেক্টরে।
বদরগঞ্জ উপজেলায় এবারে তামাক চাষ হয়েছে ৫৪ হেক্টরে। গত বছর চাষের পরিমাণ ছিল ৪৮ হেক্টর।
এবার এক একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন তারাগঞ্জের ছুটমেনানগর গ্রামের কৃষক তাজুল ইসলাম। তামাক পেয়েছেন ২৮ মণ। প্রতি কেজি তামাক কোম্পানিতে ২০৫ টাকা দরে বিক্রি করেছেন ২ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। তাঁর খরচ হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার টাকা। এক একরে তিনি এবার লাভ করেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘খতি হইলে কি হইবে আলোয়াত (তামাক) তো খরচ অল্প, লাভ বেশি। অন্য ফসলত ক্যাশ (মূলধন) মেলা লাগে, লাভ তেমন নাই। লোকসানের ঝুঁকিও আছেই। কিন্তু আলোয়াত কোনো লোকসান নাই, লাভ হইবেই।’
রংপুরে সাধারণত ধান, আলু, পাট, গম, ভুট্টা, তামাক ও সবজির চাষ হয়। কিন্তু তামাক চাষ কোনোভাবে কমছে না। বদরগঞ্জের কৃষক সাহেব আলী জানান, ৫০ শতকে আলু রোপণ থেকে উত্তোলন পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা লাগে। আছে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি। আলু তোলার পর মাঠে ভালো দাম পাওয়া যায় না। মহাজনের ঋণ শোধ করতে বাধ্য হয়ে মাঠেই আলু বিক্রি করতে হয়। সর্বোচ্চ ১২-১৪ টাকা কেজি দামে বিক্রি করে সামান্য লাভ হয়। তামাক চাষে মূলধন লাগে না। সবকিছু দেয় কোম্পানি। এসব সুবিধার কারণে তামাক চাষ করেন।
তারাগঞ্জের নারায়নজন গ্রামের কৃষক বাবলু মিয়া ১০ বছর আগে তামাক কোম্পানির প্রলোভনে ৪০ শতক জমিতে তামাক চাষ শুরু করেছিলেন। গত বছর তিনি এক একর জমিতে তামাক চাষ করেন। এবার করেছেন দুই একর জমিতে। বাবলু মিয়া বলেন, ‘তামাক কোম্পানি সবকিছু দেয়। আবাদ দেখাশোনাও করে। আমরা শুধু পরিশ্রম করি। নির্ধারিত দামে তামাকপাতা কিনেও নেন।’
তবে তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকেরা নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। অন্তত ১০ জন শ্রমিক বলেন, তামাকখেতে কাজ করলে খাবারের রুচি থাকে না। মাথা ঘোরে, বমি আসে। কিন্তু তামাকের কাজ করলে তুলনামূলক বেশি মজুরি পাওয়া যায়। এ কারণে তাঁরা ওই কাজ করেন।
এই তামাকের কাজে শিশুদের ব্যবহার বাড়ছে বলে মনে করেন রংপুরের স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন ‘আমরাও পারি’ সভাপতি আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগে কৃষি বিভাগের তামাকবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম চোখে পড়লেও এখন তা পড়ে না। তিনি অভিযোগ করেন, কৃষি বিভাগ থেকে তামাক চাষের দেওয়া পরিসংখ্যান সঠিক নয়। বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডলের দাবি, রংপুরে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে উঠান বৈঠক, সচেতনতাবিষয়ক সভা করা হয়। আগের চেয়ে তামাক চাষ কমেছে।
এদিকে রংপুরে তামাক পণ্যের ব্যবহারও বাড়ছে বলে বিভিন্ন সিগারেট কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। জেলায় তিনটি তামাক কোম্পানি প্রতি মাসে অন্তত ৩২ কোটি টাকার সিগারেট বিক্রি করছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন এ বিষয়ে তথ্য দিলেও নাম প্রকাশে রাজি হননি।
টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর অন্তত সাতজন বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তরুণ-তরুণী ও যুবকেরা প্রতিনিয়ত সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। তাই চাহিদার কারণে বিক্রি বেড়েই চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০২২ সালের ‘টোব্যাকো: থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্ট’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের দেড় কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সিগারেট খান। বিড়ি খান ৫৩ লাখ মানুষ। আর ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন।
বদরগঞ্জের একটি উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র জানালেন, তার প্রতিদিন অন্তত ১০টি সিগারেট লাগে। তার বাবাও সিগারেট টানেন। একদিন বাবার একটি সিগারেট গোপনে নিয়ে টানার পর থেকে সে–ও সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা আশিকুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, তামাকের বহুল ব্যবহারে কারণে হৃদ্রোগ, ক্যানসার, বক্ষব্যাধির মতো রোগ হয়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তামাক ব্যবহারজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় মানুষের মৃত্যুও হয়।
রংপুর কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, সরকার প্রতিবছর বাজেটে বড় অঙ্কের কৃষি ভর্তুকি প্রদান করে। তামাকচাষিরা এসব ভর্তুকি থেকে নানা কারণে বঞ্চিত হয়। কৃষি বিভাগের উচিত এঁদের কৃষি ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা।