যশোরে পাঁচ দিনে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে পুলিশের ১১ মামলা, আসামি ৭০০
যশোরে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে গত পাঁচ দিনে ১১টি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের ৭৭ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জ্ঞাত ও অজ্ঞাত মিলিয়ে আসামির সংখ্যা অন্তত ৭০০।
পুলিশ বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে এমন মামলা করা হচ্ছে। এসব মামলাকে ‘গায়েবি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা। তাঁদের দাবি, আসছে নির্বাচনে বিরোধীদের কোণঠাসা করতে পুলিশকে দিয়ে এসব মামলা করাচ্ছে সরকার।
যশোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সৈয়দ সাবেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির যেসব নেতা-কর্মীকে পোলিং এজেন্টের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, সেই সব নেতা-কর্মীর নামে নাশকতার গায়েবি মামলা দিচ্ছে পুলিশ। কোনো কারণ ছাড়াই মামলা দিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট ঘটনার অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হচ্ছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও নিয়মিত মামলার আসামিদেরকেই আটক করা হচ্ছে। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।
বিএনপির নেতা-কর্মী ও পুলিশ জানায়, ৫ থেকে ১০ অক্টোবরের মধ্যে যশোরের সাতটি থানায় ১১টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় ২০০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৭ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যশোর কোতোয়ালি, বেনাপোল, শার্শা, ঝিকরগাছা, চৌগাছা ও বাঘারপাড়া থানায় দুটি করে ও অভয়নগর থানায় একটি করে মামলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদুজ্জামানকে (৫৫) ফতেপুর গ্রামের নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মহেশপাড়া এলাকায় নাশকতার ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। শুধু ওয়াহিদুজ্জামান নন, ঝিকরগাছা উপজেলার বিএনপির এমন পাঁচ নেতাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করে মহেশপাড়া এলাকায় নাশকতা সৃষ্টির একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
৮ অক্টোবর ঝিকরগাছা থানার উপপরিদর্শক জিয়াউর রহমান বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতায় আইনে বিএনপির ২৯ নেতা-কর্মীর নাম-পরিচয় উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও ৭০ থেকে ৮০ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন। ওই মামলায় ওয়াহিদুজ্জামানসহ বিএনপির ছয় নেতাকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মামলা এজাহারে বলা হয়েছে, ৭ অক্টোবর রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ঝিকরগাছার মহেশপাড়া বাজারসংলগ্ন এলাকায় নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পেট্রলবোমা ও রড নিয়ে সংঘবদ্ধ লোকজন অপেক্ষা করছেন, এমন খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে আসামিরা দৌড়ে পালিয়ে যান। তখন ঘটনাস্থল থেকে ছয়জনকে আটক করা হয়।
আটক ওয়াহিদুজ্জামানের ছেলে সোহেল পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আর আব্বু ৭ অক্টোবর সকালে আমাদের নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসেছিলাম। এ সময় ঝিকরগাছা থানার উপপরিদর্শক অমৃতলাল দাসসহ পুলিশের দুই সদস্য সেখানে গিয়ে আব্বুকে জোর করে তুলে নিয়ে যান। পরে মহেশপাড়া নামক এলাকায় নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।’
এই মামলায় গ্রেপ্তার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের, শংকরপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ফয়জুর রহমান, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল হক, জামায়াতে ইসলামীর দুজন কর্মী আনারুল ইসলাম ও ইয়াসিন আলী।
মামলার আসামি ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোর্তজা এলাহী বলেন, ‘ঝিকরগাছায় নাশকতা বলে কোনো কিছুই হয়নি। মামলায় ঘটনার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, তখন আমি ঝিনাইদহ জেলায় অবস্থান করছিলাম। শুধু আমি নই, আসামিদের কেউ ঘটনাস্থলের আশপাশেই ছিলেন না। বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক করে সবাইকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।’
এদিকে মঙ্গলবার চৌগাছা থানায় নাশকতার আরও দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় ৪৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা দুটির বাদী চৌগাছা থানার উপরিদর্শক মধুসূদন বিশ্বাস। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ১০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ছয়টায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও খালেদা জিয়ার মুক্তির এক দফা দাবিতে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা টেঙ্গুরপুর গ্রামের মোড়ে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তাঁরা পালিয়ে যান। এ সময় তাঁদের ফেলে যাওয়া অবিস্ফোরিত ককটেল, রড ও লাঠিসোঁটা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় অপর এক মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করে আরও একটি মামলা করে পুলিশ। ওই মামলায় বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপির পাঁচ নেতা-কর্মীকে আটক করে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন চৌগাছা উপজেলার স্বরূপদাহ ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আবদুল ওহাব, সদস্য ইসারুজ্জামান, ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম, খড়িঞ্চা ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি শফিউদ্দিন। চৌগাছা বিএনপির আহ্বায়ক জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার বেসামাল হয়ে পুলিশকে ব্যবহার করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ গায়েবি মামলা সাজিয়ে আটক করছে। চৌগাছা থানায় একই দিনে দুটি গায়েবি মামলা দিয়ে ৪৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির আন্দোলন থামাতে সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে।’
আরও তিনটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি মামলার এজাহারে একই ধরনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে মামলা সাজানো হয়েছে। সব মামলায় আসামি বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।