অন্তেহরির অথই জলে ‘গয়নার নৌকা’

পর্যটক নিয়ে পানিতে ভাসছে নৌকা। শনিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরিতেছবি: প্রথম আলো

তখনো সন্ধ্যার বেশ বাকি। তবে আকাশটা ছাইসাদা মেঘে মেঘে ছাওয়া, সূর্যটা মেঘের আড়ালে থাকায় মনে হয়, সন্ধ্যা নেমেছে। নরম বাতাস বইছে হাওরের জলের বুকে। গাছপালায় বাতাসের সেই দোলা। জলের ওপর ঢেউয়ের মাখামাখি, ছলছলাৎ করে একে অপরের গায়ে পড়ছে। টুকরাটাকরা মেঘ জলের বুকে ভেঙেচুরে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে।

দূরে অনেকগুলো ছোট-বড় নাও ভাসছে। কেউ মাছ ধরছেন। কেউ খোলা নৌকায় বসে শরীরে হাওরের জলের বাতাস মাখছেন। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরের এক পাশে ‘জলের গ্রাম অন্তেহরি’ এখন এ রকমই বর্ষাকাতর আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসমান উজ্জ্বল হাঁসের মতো এক চঞ্চল জলকন্যা। কাউয়াদীঘি হাওর মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগরে বিস্তৃত যদিও, তবে অন্তেহরি গ্রামটি পড়েছে জেলার রাজনগর উপজেলায়।

শনিবার বিকেলে মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে অটোরিকশায় করে অন্তেহরি যাওয়ার পথে সদর উপজেলার জগৎপুর এলাকা পার হতেই বোঝা গেছে, হাওরে অনেক পানি। পথের দুই পাশে ছলছল করা জল। কোথাও সড়কটি ভেজা। হয়তো সড়কটি পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। কিছুটা পানি কমেছে। কালো পিঠ নিয়ে ভেসে উঠেছে সড়ক। সড়কের পাশে অনেক বাড়ির উঠানে পানি। কোনো বাড়ির পথ ডোবানো। অন্তেহরির কাছে কাদিপুরে গিয়েই থমকে যায় গাড়ির চাকা। সড়কে ঊরুসমান পানি। কচুরিপানায় ভরে আছে সড়ক। ওখানেই নৌকার ঘাট। কাদিপুরে বর্ষার অস্থায়ী ঘাটে অনেকগুলো ছোট-বড় নাও। কোনোটা কালো হাঁসের মতো পানিতে ভেসে ছুটছে গন্তব্যের দিকে। কোনোটা ঘাটে এসে ভিড়ছে। স্থানটি নৌকার মাঝি, নৌকার যাত্রী ও নানা জায়গা থেকে হাওরে ঘুরতে আসা মানুষের কোলাহলে সরগরম হয়ে আছে।

তখন দিন শেষে অনেকে নানা জায়গা থেকে বাড়ি ফিরছেন। এই ‘গয়নার নৌকা’য় করে কেউ যাচ্ছেন অন্তেহরি বাজারের ঘাটে। পথে কারও বাড়িতে নামিয়ে দেওয়া হবে যাত্রীকে। গয়নার নৌকাগুলো হাওরের পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে গেলে ভাড়ায় যাত্রী আনা-নেওয়া করে। সবার তো আর নিজের নৌকা নেই। ঘর থেকে বের হলেই নৌকা লাগে। উঠান ডুবেছে কারও, কারও বাড়ির চারপাশে থই থই পানি। অন্তেহরি গ্রামে রাতদিন এমন ছোট-বড় নৌকার বৈঠার ছপছপ করা শব্দ কমবেশি সবারই চেনা।

এ সময়টিতে জলের গ্রাম অন্তেহরি হয়ে ওঠে অনেকের কাছে অন্য এক আদর-আহ্লাদের জলাভূমি। নগরের ব্যস্ত, ক্লান্ত, হাঁপিয়ে ওঠা মানুষেরা কেউ বন্ধুবান্ধব, কেউ সপরিবার ছুটে আসেন এখানে, এই অন্তেহরিতে। কাদিপুরেই ভাড়ার নৌকা থাকে। দরদাম করে তারা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন হাওরের বুকে। অন্তেহরির বুকেই তাঁরা অথই জলে ভাসেন। যার যার ইচ্ছেমতো নৌকার দোলায় ভেসে বেড়ান। কেউ দুই-চার ঘণ্টা, কেউ সারা দিনের জন্য নৌকা ভাড়া করেন। নৌকার ভাড়াটাও সেভাবেই বাঁধা। কোনো মাঝি জনপ্রতি ৮০ বা ১০০ টাকা ভাড়া নেন। কেউ ঘণ্টা হিসাবে। মোটামুটি একটি নৌকা নিয়ে এক-দুই ঘণ্টা ঘুরে বেড়াতে পাঁচ-সাত শ টাকার মধ্যেই থাকে। ভাড়াটা নির্ভর করে সময় ও সংখ্যাভেদে।

গয়না নৌকার মাঝিরা জানান, শুক্র ও শনিবার কিংবা যেকোনো ছুটির দিনেই ভিড়টা একটু বেশি হয়। জেলা শহর থেকে ৮-১০ কিলোমিটারের দূরত্বে থাকায় বিকেলেই লোকজন বেশি হয়ে থাকে। আশপাশের গ্রাম থেকেও অনেকে আসেন। দিনের সবকিছু গুছিয়েই অনেকে ওদিকে পা বাড়ান। তবে অন্য দিনেও কমবেশি পর্যটক থাকেন। ১০-১৫টি ছোট-বড় নাও আছে, যার মাঝিরা লোকজনকে হাওর–ভ্রমণের আনন্দ জুগিয়ে চলেছেন। এটি তাদের মৌসুমি পেশা হলেও এ কাজটিতে তাঁদের আনন্দেরও যোগ আছে।

বিপুল বৈদ্য নামের এক মাঝি জানান, তাঁদের তো পানির সঙ্গে যুগ–যুগের বাস। পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায়, ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় অনেকেই দুর্ভোগে আছেন; কিন্তু এ রকম দুর্ভোগ বা জীবনযাপনের সঙ্গে বহুকালের চেনাজানা তাঁদের। এ নিয়ে বাড়তি কোনো ভাবনা, কষ্টবোধ নেই। প্রকৃতির এই নিয়মেই বাঁধা তাঁদের ঘর-সংসার। এই পানির কারণেই গ্রামে বাইরের লোকজন আসছেন, এতেই তাঁরা খুশি।