গাজীপুরে দুই ট্রেনের সংঘর্ষের ৩১ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক
গাজীপুরে সংকেতের ভুলে তেলবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ৩১ ঘণ্টা পর উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইনের মেরামত শেষে আজ শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর জংশনের দক্ষিণে ছোট দেওড়া আউটার সিগন্যালে উত্তরবঙ্গগামী তেলবাহী ট্রেন ও ঢাকাগামী টাঙ্গাইল কমিউটার যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুটি ট্রেনের নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয় এবং ট্রেনের চালকসহ চারজন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার পর থেকে ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহ, উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ট্রেনের যাত্রাও বাতিল করা হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় ট্রেন চালুর পর স্টেশনে অপেক্ষারত যাত্রীদের ভোগান্তি অবশেষে শেষ হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে এই সংঘর্ষের ঘটনার পর জয়দেবপুর স্টেশন দিয়ে ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম রেললাইনে ট্রেন চলাচল প্রায় আড়াই ঘণ্টা বন্ধ থাকে। বিকেলে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়। এ ছাড়া টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের পেছনের অংশের অক্ষত বগিগুলো বিকল্প ইঞ্জিনের মাধ্যমে দুর্ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। রাতভর উদ্ধার অভিযানে তেলবাহী ওয়াগনের লাইনচ্যুত পাঁচটি বগির মধ্যে তিনটি বগি অপসারণ করে পাশের স্টেশনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আজ সকাল থেকে আবার উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। উদ্ধার অভিযান চলাকালে ডাউন লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করলেও দুপুরের পর বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই লাইনও। পরে চলে উদ্ধার অভিযান। একটি উদ্ধারকারী ট্রেন ডাউন লাইনে বসিয়ে ইঞ্জিন ও ওয়াগন সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে উদ্ধারকারী ট্রেনটি লাইন থেকে সরিয়ে নিলে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে জয়দেবপুর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) সেতাফুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনের যে শিডিউল বিপর্যয় হয়েছিল, তা এখনই শেষ হয়ে যাবে। ট্রেন চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। দুর্ঘটনাটি যেকোনো একটি ভুলের কারণেই হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষ হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উদ্ধার অভিযান দেরি হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে তেলের ওয়াগন ছিল। এ কারণে খুবই সতর্কতার সঙ্গে উদ্ধারকাজ করতে হয়েছে।
জয়দেবপুর জংশনের কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনার পর থেকে ময়মনসিংহ, উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল রুটে সব কটি ট্রেনের ব্যাপক শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। এ কারণে সকাল থেকে জয়দেবপুর জংশন, টঙ্গী স্টেশনসহ আশপাশের প্রায় প্রতিটি স্টেশনের যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। ছয়টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। অনেকে ট্রেন না পেয়ে ফিরে গেছেন। নির্ধারিত সময়ে ট্রেন না আসায় যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
আজ দুপুরে সরেজমিনে জয়দেবপুর রেলজংশনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জেলার শত শত যাত্রী ট্রেনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। তাঁরা নির্ধারিত সময়ে ট্রেন স্টেশনে না আসায় অপেক্ষা করছেন। অনেকে স্টেশনমাস্টারের কাছে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন তাঁদের ট্রেন কখন আসবে বা ছেড়ে যাবে। কিন্তু কোন ট্রেন কখন আসবে, তা স্টেশনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানাতে পারেননি।
এ ছাড়া দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, রেললাইনে এখনো একটি তেলের ওয়াগন রয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত লাইনের দুই পাশে ব্লক করে স্লিপার পাল্টানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। অপর লাইনে কিছুক্ষণ পরপর একেবারেই ধীরগতিতে ট্রেন চলাচল করছে। রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের কর্মীদের কাজ করতে দেখা গেছে।
জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনের স্টেশনমাস্টার হানিফ মিয়া বলেন, ডাবল লাইনটি বন্ধ থাকায় সিঙ্গেল লাইন দিয়ে পার্শ্ববর্তী ধীরাশ্রম স্টেশন ও জয়দেবপুর জংশনে ট্রেন অপেক্ষমাণ রেখে একটি একটি করে ট্রেন দুই দিকে চলতে দেওয়া হচ্ছে। ফলে কোনো ট্রেনেরই শিডিউল ঠিক থাকছে না।
জয়দেবপুর জংশনে কথা হয় যাত্রী কবির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে খবর পেয়ে সকালে স্টেশনে এসে ট্রেনের কোনো দেখা পাইনি। এক-দেড় ঘণ্টা ধরে বসে আছি। কখন ট্রেন পাব, তার কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছি না।’ আরেক যাত্রী আক্তার হোসেন বলেন, ‘এক ঘণ্টার বেশি সময় ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করেছি। কিন্তু ট্রেন পাইনি। এ কারণে ফিরে যাচ্ছি। ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আজ আর যাব না।’
তদন্ত শুরু করেছে জেলা প্রশাসনের কমিটি
দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি আজ তদন্তকাজ শুরু করেছে। প্রথমে এ কমিটির প্রধান ও গাজীপুর জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মতিউর রহমান দুর্ঘটনার দিন জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনে কর্তব্যরত স্টেশনমাস্টার আবুল হাসেম আবুল হাসেম, পয়েন্টস ম্যান সাদ্দাম ও মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
এ সময় তদন্ত কমিটির সদস্য গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন ও জয়দেবপুর জংশনের স্টেশনমাস্টার মো. হানিফ মিয়া তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্তের বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরে দুপুরে স্টেশনমাস্টার আবুল হাসেম, পয়েন্টস ম্যান সাদ্দাম ও মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎকার এবং তাঁদের লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেন। পরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি দুর্ঘটনাকবলিত টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের যাত্রী শরীফ মাহমুদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সেখানে ভর্তির পর চালক সবুজ হাসান ও হাবিবুর রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর হওয়ায় তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হয়নি।