এক দিনে মা মর্জিনা বেগমের (৪০) কাছ থেকে মাদক কেনার জন্য চার দফায় ৩০০ টাকা নেন ছেলে রাকিব জোয়াদ্দার (১৮)। রাত ১১টার দিকে আরও একবার মাদক কেনার জন্য মায়ের কাছে এক হাজার টাকা দাবি করেন। ওই টাকা না দেওয়ায় ডাব ব্যবসায়ী বাবার দা দিয়ে কুপিয়ে মাকে আহত করেন ছেলে। তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত শনিবার ওই নারী মারা যান।
ঘটনাটি ঘটেছে ফরিদপুরের মুধখালী পৌর শহরের মেছড়দিয়া গ্রামে। পুলিশ, স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডের এই কারণ সম্পর্কে জানা গেছে। নিহত মর্জিনা বেগম মেছড়দিয়া গ্রামের জামাল জোয়াদ্দারের স্ত্রী। মাকে হত্যার অভিযোগে রাকিব এখন কারাগারে।
স্থানীয় লোকজন জানান, এ বছরের শুরুর দিকে রাকিবকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠান মা-বাবা। সেখানে পাঁচ মাস থেকে এসেও কোনো উন্নতি না হওয়ায় জুলাইয়ে আবারও তাঁকে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পালিয়ে তিনি আগস্টে বাড়িতে চলে আসেন। এর পর থেকে বাড়িতেই থাকতেন।
রাকিবের প্রতিবেশী মো. হুমায়ুন জোয়াদ্দার (৩৫) বলেন, গত মঙ্গলবার চার দফায় মায়ের কাছ থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে হোমিওপ্যাথির ওষুধের দোকান থেকে অ্যালকোহল কিনে সেবন করে রাকিব। ওই দিন রাত ১০টার দিকে ৫০০ টাকা নিয়ে রাকিব ইয়াবা বড়ি কিনতে যায়। যাঁর কাছ থেকে ইয়াবা কিনতে যায়, তিনি রাকিবের কাছে ১ হাজার ৫০০ টাকা পেতেন। ওই ৫০০ টাকা রেখে রাকিবকে আরও ১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলেন মাদক ব্যবসায়ী। ইয়াবা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে রাত ১১টার দিকে বাড়িতে ফেরে রাকিব। এরপর মায়ের কাছে এক হাজার টাকা চায়। টাকা না থাকায় দিতে পারবে না বলে জানান মর্জিনা বেগম। তখন রাকিব হাতের কাছে পাওয়া দা দিয়ে কুপিয়ে মাকে আহত করে।
প্রতিবেশীরা জানান, রাকিবরা তিন ভাই। অন্য দুজনের বয়স যথাক্রমে ১২ ও ৮। রাকিব দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এর পর থেকে আর স্কুলে যাননি। তাঁর বাবা গ্রাম থেকে ডাব কিনে মধুখালী পৌর শহর বাজারে ভ্যানে করে বিক্রি করেন। ছোটবেলা থেকেই রাকিব বাবার সঙ্গে কখনো ডাব বিক্রিতে সহায়তা করেছেন, কখনো রিকশা–ভ্যান চালিয়েছেন। তবে নিজের আয়ের টাকা কখনোই সংসারে দেননি। সব টাকা ব্যয় করতেন মাদক সেবনে। এক বছর ধরে তিনি কোনো কাজই করতেন না। প্রতিদিন মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবন করতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই গ্রামের এক বাসিন্দা (৩০) বলেন, এলাকায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয় ও পুলিশের নির্লিপ্ততায় মাদকের ভয়াবহতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণে কিশোর বয়সী ছেলেদের হাত পর্যন্ত খুব সহজে মাদক পৌঁছে যাচ্ছে। এসব নিয়ে প্রতিবাদ করায় ওই গ্রামের রমজান খান (৩২) নামের এক ব্যক্তিকে লাঠিসোঁটা দিয়ে মারধর করে এ চক্রের সদস্যরা। পুলিশ মাঝেমধ্যে ছোট মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে কারাগারে পাঠালেও মাসখানেকের মধ্যে বের হয়ে আবার ব্যবসা শুরু করেন। বড় ব্যবসায়ীদের ধরা হয় না।
মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, মধুখালীতে তরুণ সমাজের মধ্যে মাদকদ্রব্য সেবনের প্রবণতা আছে। তবে বড় কোনো মাদক ব্যবসায়ী নেই। যাঁরা মাদক ব্যবসায়ী, তাঁরা বর্তমানে কারাগারে আছেন। তবে যাঁরা মাদকসেবী, তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনে দূরে থেকেও মাদক সংগ্রহ করে থাকতে পারেন।
মেছড়দিয়া মহল্লার বাসিন্দা ও রাকিবের প্রতিবেশী রমজান খান বলেন, রাকিব ছোটবেলা থেকে বখাটে। ওর বাবা গরিব মানুষ হয়েও ছেলেকে মাদকমুক্ত করতে বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছেন। তবে এতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। দুই-আড়াই বছর ধরে বাবা জামাল জোয়াদ্দার রাকিবের সঙ্গে সেভাবে কথা বলতেন না। রাকিব তার প্রয়োজনীয় বিষয় মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিত।
রমজান খান আরও বলেন, মায়ের আদরে ছেলে উচ্ছন্নে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করতেন জামাল। এ নিয়ে স্বামী–স্ত্রীর ঝগড়াও হতো। তবে এসব কথা না শুনে মর্জিনা বেগম স্বামীর পকেট থেকে টাকা চুরি করেও ছেলেকে দিতেন।
মধুখালী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঘটনাটি বেদনাদায়ক। একটি সাজানো পরিবারকে মাদকের বিষাক্ত থাবা কীভাবে শেষ করে দিল, এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। মাদকের বিস্তার এমনভাবে ঘটেছে যে আজকাল ১২ থেকে ১৩ বছরের ছেলেমেয়েরাও এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।