পদপদবিতে ভারী আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকে হারিয়ে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জয়ী হয়েছেন। একইভাবে জেলার নবীগঞ্জে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরীর কাছে হেরেছেন ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলীয় বিধিনিষেধ না থাকায় প্রতিটি উপজেলায় দলের পাঁচ থেকে সাতজন প্রার্থী মাঠে ছিলেন। দলের ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের কেউই জয়ী হতে পারেননি। তবে জয়ী প্রার্থীরা বলছেন, ব্যক্তি ইমেজের কারণে তাঁরা জয় পেয়েছেন।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে গতকাল মঙ্গলবার নবীগঞ্জ ও বাহুবল উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নবীগঞ্জে চেয়ারম্যান পদে জয় পাওয়া মুজিবুর রহমান চৌধুরী জেলা বিএনপির সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপি তাঁকে বহিষ্কার করেছে। বাহুবলে জয়ী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন পেশায় একজন রিক্রুটিং এজেন্ট ব্যবসায়ী। তিনি প্রয়াত আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরীর (ফুলতলী হুজুর) অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
নবীগঞ্জে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ছিলেন আটজন। এর পাঁচজনই আওয়ামী লীগের। তাঁরা হলেন উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মো. ফজলুল হক চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এ কে এম নূর উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইমদাদুর রহমান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বোরহান উদ্দিন চৌধুরী।
নির্বাচনে জয়ী হন মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী। তিনি চিংড়ি মাছ প্রতীকে ২৫ হাজার ১৫৯ ভোট পান। তাঁর নিকটতম আওয়ামী লীগের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. ফজলুল হক (ঘোড়া) পেয়েছেন ২১ হাজার ৭৫১। এ দুজনের ভোটের ব্যবধান ৩ হাজার ৪০৮।
দলীয় কোন্দল ও একাধিক প্রার্থী থাকাই পরাজয়ের মূল কারণ বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গিয়াস উদ্দিনের মতে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। যে কারণে এই ভরাডুবি। আওয়ামী লীগের ভোট যদি ৫ শতাংশ পড়ে, তাহলে এখানে তো পরাজয় বরণ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
তবে বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমানের ‘ব্যক্তি ইমেজও’ প্রভাব হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন নবীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী শাহ শামীম আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের এতগুলো নেতাকে ডিঙিয়ে বিএনপির নেতার জয়ের পেছনে ছিলেন এলাকার নিরপেক্ষ ও সাধারণ ভোটাররা। মুজিবুর রহমান তৃণমূলের একজন রাজনীতিবিদ। তিনি সব সময়ই মানুষের পাশে থেকে কাজ করছেন। এখানে দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তি ইমেজের কারণে তিনি জয়ী হয়েছেন।
নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার রাজনীতি ছিল মানুষের জন্য। মানুষ আমাকে ভালোবাসেন, তার প্রমাণ পেয়েছি এ নির্বাচনে। জয়ের পেছনে তাঁর দলীয় পরিচয় নয়, ব্যক্তিগত ইমেজ কাজ করছে।’
বাহুবলেও আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে দোয়াত-কলম প্রতীকে ১৮ হাজার ৬৮২ ভোট পেয়ে জয়ী হন নির্দলীয় মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আবদুল হাই (টেলিভিশন) পেয়েছেন ১২ হাজার ৭৮৪ ভোট।
চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আওয়ামী লীগের অন্য প্রার্থীরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. আবদুল কাদির চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাজন চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আখতারুজ্জামান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক শেখ মো. ফিরোজ আলী মিয়া। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী রাজন চৌধুরী হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর বড় ভাই। আখতারুজ্জামানও যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। তিনি হবিগঞ্জ-৩ (সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মো. আবু জাহিরের শ্যালক। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান সৈয়দ খলিলুর রহমান এবারও নির্বাচনে লড়াই করে ২৬৯ ভোট পান।
নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাদের হারিয়ে জয়ী হওয়া আনোয়ার হোসেনকে নিয়েই সর্বত্র আলোচনা। এই প্রথম নির্বাচন করে চমক দেখান তিনি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী থাকায় তিনি জয় পেয়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন এলাকায় ধনাঢ্য হিসেবে পরিচিত। ঢাকায় তাঁর একটি রিক্রুটিং এজেন্সির ব্যবসা রয়েছে। তিনি প্রায় তিন বছর আগে থেকেই নির্বাচন করার ইচ্ছে নিয়ে এলাকায় আসা-যাওয়া করতেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে দান করেও আলোচনায় আসেন তিনি।
আনোয়ার হোসেন ফুলতলী হুজুরের অনুসারী। ফুলতলী হুজুরের সংগঠন আঞ্জুমানে আল ইসলাহের অসংখ্য ভক্ত ও মুরিদ আছেন উপজেলায়। উপজেলা সদরের ভোটার বশির আহমেদ বলেন, মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেশি থাকায় দলটি সুবিধা করতে পারেনি। এ ছাড়া এলাকায় ফুলতলী হুজুরের অসংখ্য মুরিদ আছেন। আনোয়ার ভক্তদের ভোট কাজে লাগিয়েছেন।
বাহুবল উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম সোহেল আহমেদ বলেন, ‘এটা সত্য, আমরা উপজেলা নির্বাচনে ভালো করতে পারিনি নিজেদের একাধিক প্রার্থী হওয়ার কারণে। দল থেকে কোনো বাধা না থাকায় উন্মুক্ত এ নির্বাচনে সবাই অংশ নেওয়ায় এখানে আওয়ামী লীগের ভোট বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ সুযোগটি কাজে লাগায় জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী।’
নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি সার্থক, ভোটারদের নির্বাচনমুখী করতে পেরেছি। আমি প্রার্থী না হলে এখানে একপেশে নির্বাচন হতো।’ কোনো দলের পরিচয়ে নয়, জনগণের হয়ে কাজ করতে চান সাধারণ মানুষের জন্য।