ধামরাইয়ে ভেঙে দেওয়া হলো একটি মাজার
মাজারটির প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে মাজার। পাশেই আরেকটি থাকার ঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে। দোচালা টিনের অপর ঘরটির দুই পাশের টিনের কিছু অংশে আঘাতের চিহ্ন। বারান্দায় বসে মলিন মুখে মাজারটি দেখছিলেন আমেনা বেগম (৭৫)।
আজ শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকার ধামরাই উপজেলার গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের অর্জুন নালাই গ্রামের মৃত শুকুর আলীর বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে শুকুর আলী শাহ ফকিরের মাজার ভাঙচুরসহ একটি বসতঘর ভাঙচুর এবং আরেকটি বসতঘরের দুই পাশের টিনের বেড়ার কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়। এ ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতার কারণে শুকুর আলীর দুই ছেলে তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, ধামরাই ওলামা পরিষদ, ইমাম পরিষদের নেতা-কর্মীসহ স্থানীয় কয়েকটি মসজিদ ও মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কয়েকজন এ ঘটনায় জড়িত।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গতকাল বিকেলে শুকুর আলী শাহ ফকিরের মাজারে ৬৬তম ওরসের আয়োজন করা হয়। এ উপলক্ষে সন্ধ্যায় মিলাদ মাহফিল ও তবারক বিতরণ শেষে রাতে বাউলগান হওয়ার কথা ছিল। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ধামরাই ওলামা পরিষদ ও ইমাম পরিষদের নেতা–কর্মী, স্থানীয় কয়েকটি মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় কয়েকজন মাজারের অদূরে অর্জুন নালাই জামে মসজিদে জড়ো হন। সেখানে তাঁরা শুকুর আলী শাহ ফকিরের মাজারে ওরস ও গানের আয়োজন বন্ধের দাবি জানান। পরে রাত ৮টার দিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় ধামরাই থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শেষে ওরস বন্ধের কথা জানালে আয়োজনকারীরা ওরস বন্ধ করেন। এরপর তাঁরা আয়োজকদের গ্রেপ্তারসহ মুচলেকা নেওয়ার দাবি জানান। তবে পুলিশ এতে রাজি না হয়ে চলে যায়। পুলিশ চলে যাওয়ার পর তাঁদের একটি অংশ মাজারের কার্যক্রম বন্ধের জন্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করবেন জানিয়ে মসজিদ ত্যাগ করেন। এরপর রাত ১০টার দিকে সেখানে উপস্থিত অপর অংশের ৫০-৬০ জন দল বেঁধে মাজারটিতে ঢুকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। সেখানে থাকা দুটি কবরসহ বসতবাড়ির একটি টিনের ঘর পুরোপুরি এবং অপর একটি ঘরের বেড়ার টিন ভাঙচুর করা হয়। হামলার পরপরই শুকুর আলীর দুই ছেলে আতঙ্কে স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান। তবে শুকুর আলীর স্ত্রী আমেনা বেগম হামলাকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বিকেলের দিকে বহিরাগত শতাধিক মুসল্লি মসজিদে জড়ো হন। এরপর তাঁরা মাজারে গান–বাজনা বন্ধ করতে বলেন। স্থানীয় কিছু লোকও ছিলেন সেখানে। তাঁরা মসজিদের মাইকে ওই মাজারে সিজদা দেওয়া, মানত করা, পীরকে সিজদা করা চলবে না বলে স্লোগান দেন। রাত ১০টার দিকে ৫০-৬০ জন মুসল্লি গিয়ে মাজার ভেঙে ফেলেন।
আমেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাজারে মোমবাতি আর আগরবাতি জালাইতাম। বহু বছর ধইরা ওরস হয়। গতকাল মুসল্লিরা নিষেধ করছিল ওরস করতে, আমরা বন্ধ করছিলাম। এরপর রাইতে ৫০-৬০ লোক আইসা মাজার ও ঘর ভাইঙ্গা দিছে। ওরা আমারে মারতে চাইলে মারুক। ভয়ে পোলারা বউ–পোলাপান নিয়া চইলা গেছে। পুলিশ আইছিল, কইছে মামলা করতে। আমরা মামলা করলে মামলা চালামু কেমনে।’
ধামরাই উপজেলা ওলামা পরিষদের সভাপতি মুফতি সানাউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ আসে, ওই বাড়িতে মাদক ব্যবসাসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত হতে গতকাল ধামরাই উপজেলা ইমাম পরিষদ ও আমাদের কয়েকজন নেতা ওই বাড়ির পাশেই একটি মসজিদে জড়ো হই। আমাদের মূল লক্ষ ছিল গান–বাজনা বন্ধ করা। ভাঙচুর কোনো সমাধান নয়। যখন পুলিশের কাছে তাঁরা ওরস বন্ধ করা হয়েছে জানান, তখন আমরা এশার নামাজ শেষে চলে আসি। এরপর শুনেছি, স্থানীয় কিছু ব্যক্তি তাঁদের ক্ষোভ থেকে মাজার ভেঙেছেন। আমাদের লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ সমাধান, ভাঙচুর নয়।’
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ধামরাইয়ের বাটুলিয়া কালামপুর-সাটুরিয়া আঞ্চলিক সড়কের পাশে বুচাই পাগলার মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া হামলার ঘটনা ঘটে উপজেলার ইসলামপুর এলাকায় ‘বরকত মা’ মাজারে। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে দাবি করেন তাঁরা।
ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
ওসি বলেন, ধামরাইয়ের ইসলামপুরে ‘বরকত মা’ মাজারটিতে হামলার চেষ্টা হয়েছিল। বুচাই পাগলার মাজারে হামলা ও ভাঙচুর হয়। বুচাই পাগলার মাজারের ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল।