এক চোখে পুলিশের গুলি, অন্য চোখে বুটের আঘাত
স্নাতকের শিক্ষার্থী মেরাজ উদ্দিন পোশাকশ্রমিক বাবাকে সহায়তা করতে নিজেও টেকনিশিয়ান হিসেবে কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়। ৫ আগস্ট তাঁর ডান চোখ, মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ছররা গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ মেরাজের অন্য চোখে বুট দিয়ে আঘাত করে পুলিশ। শরীরের গুলি বের হলেও চোখের ভেতরে ও মাথায় এখনো আটকে আছে গুলি। গুলিবিদ্ধ চোখে আলো নেই। ফিরবে কি না সেটাও জানেন না।
মেরাজের বাড়ি ময়মনসিংহ নগরীর পুলিশ লাইনসের জেল রোড কাশর এলাকায়। বাবার নাম মিনহাজ উদ্দিন। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে মেরাজ বড়। তিনি নগরের আনন্দ মোহন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
বাবা মিনহাজ উদ্দিন গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। পরিবার নিয়ে কোনাবাড়ী এলাকায় থাকেন। অভাবের সংসারে সহায়তা করতে সাত মাস আগে একটি পোশাক কারখানায় টেকনিশিয়ানের কাজ নেন মেরাজও।
বুধবার সকালে মেরাজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছেন তিনি। পাশের কক্ষে বাবা-মা ও বোন। চোখে কালো চশমা পরা।
আক্রান্ত হওয়ার বর্ণনা দিয়ে মেরাজ উদ্দিন বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই রাস্তায় ছিলেন। ৫ আগস্ট সকালে কোনাবাড়ী এলাকায় অবস্থান করছিলেন। একদিকে ২০০ থেকে ২৫০ পুলিশ অন্যদিকে ছাত্র-জনতা। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করে। যাঁরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন, তাঁদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ হন। তাঁরা কয়েকজন তখন রাস্তায় বসে পড়েন। একটু থামলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন আবার গুলি করা হয়।
মেরাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার ডান চোখে, মাথায় ও হাতে ছররা গুলি লাগে। শরীর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে শুরু করে এবং রক্ত দেখে বুঝতে পারি গুলি লেগেছে। ওই সময় পুলিশের একটি দল আমার কাছে এসে পেটাতে শুরু করে। এক চোখে গুলি লাগে, আরেক চোখে বুট (জুতা) দিয়ে আঘাত করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার চোখের পানি মোছেন মেরাজ উদ্দিন। পাশে বসে কাঁদছিলেন বাবা-মা। মেরাজ বলেন, ‘যখন জ্ঞান ফেরে, তখন আমার শরীরের ওপর কারও পা, কারও হাত, কারও মাথা ছিল। বুঝতে পারি, একটি কক্ষে মানুষের স্তূপের ভেতরে আমি। তখন চিৎকার শুরু করি বাঁচাও বলে। তখন দুজন পুলিশ আমাকে টেনে বের করে রাস্তায় ফেলে দেয়। তখন বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করলে একজন বৃদ্ধ লোক এসে তুলে নিয়ে যায়।’
মেরাজ আরও বলেন, ‘ডান চোখে এখন দেখতে পাই না। দেশের জন্য নেমে চোখের আলো হারিয়েছি। আমার এমন পরিণতি হবে ভাবিনি। আমার মা-বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। এখন জীবন অনেক কঠিন হয়ে গেল। দেশের বাইরে চিকিৎসা নিলে কিছুটা ভালো হতে পারে বলছে অনেকে।’
ছেলের চিকিৎসার কাগজ দেখাচ্ছিলেন বাবা মিনহাজ উদ্দিন। সিটি স্ক্যান ও এক্স-রেতে দেখা যায়, মেরাজের ডান চোখের ভেতরে দুটি ও মাথায় চারটি গুলি এখনো থেকে গেছে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। ৬ আগস্ট থেকে হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে আছেন মেরাজ। ২৫ আগস্ট মেরাজকে সাত দিনের ছুটি দেওয়া হয়। ১ সেপ্টেম্বর আবার হাসপাতালে ভর্তি হবেন।
বাবা মিনহাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে একজন ফোন করে তাঁদের ঘটনাটি জানান। যাঁরা উদ্ধার করেছিলেন, তাঁরাই ছেলের মেসে (কোনাবাড়ীতে) পৌঁছে দেন। ৬ আগস্ট ভোরে ময়মনসিংহ থেকে গিয়ে ছেলেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু চিকিৎসকেরা অবস্থা খারাপ দেখে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন। রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ৬ আগস্ট রাতেই চোখের টিস্যু সার্জারি করা হয়। কিন্তু গুলি বের করা যায়নি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, চোখের গভীরে চলে গেছে গুলি। অস্ত্রোপচার করে বের করতে গেলে চোখ একেবারে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।
হাসপাতালে চিকিৎসার সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম মেরাজকে দেখতে গিয়েছিলেন।
মেরাজের বাবা মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ‘ছাত্রনেতাদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম, দেশের বাইরে নিয়ে যেন আমার ছেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ, চিকিৎসকদের কথায় বুঝতে পেরেছি, দেশের চিকিৎসায় ছেলের চোখের আলো হয়তো আর ফিরবে না। ভেবেছিলাম, ছেলে আমার কষ্ট দূর করবে কিন্তু আমার ছেলের জীবনেই অন্ধকার নেমে এল।’
মা শান্তনা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তো একটাই ছেলে। তাঁর পাশে দাঁড়ানোর তো কেউ নেই। ছেলের ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না। ছেলের এমন অবস্থা খুবই কষ্টের। দেশের জন্য আমার ছেলের ক্ষতি হয়েছে। সরকারের কাছে আবেদন জানাই, ছেলের সুচিকিৎসার জন্য যদি দেশের বাইরেও নিতে হয়, তা যেন করা হয়। তাহলে সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’