আলোহীন চোখে নুরদের মর্যাদায় বেঁচে থাকার লড়াই

এই পরিবারের নয়জন সদস্যের মধ্যে সাতজনই প্রতিবন্ধী। দারিদ্র্যের চাপে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেলেও পরিবারটি কারও কাছে হাত পাতে না। শনিবার দুপুরে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের সানকার চওড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

এক পরিবারের সদস্য নয়জন। এর মধ্যে সাতজনই প্রতিবন্ধী। পাঁচজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, একজন বাক্‌প্রতিবন্ধী, আরেকজন শ্রবণপ্রতিবন্ধী। দারিদ্র্যের চাপে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেলেও পরিবারটি কারও কাছে হাত পাতে না। সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের তরফ থেকে কিছুটা ভাতা পায়; বাকিটা চালিয়ে নেয় নিজেদের আয়ে।

পরিবারটির বসবাস লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের সানকার চওড়া গ্রামে। পরিবারের আয়ের বেশির ভাগের জোগান দেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নুর নবী (২৪)। তিনি একজন শিল্পী। দোতরা হাতে সুরেলা কণ্ঠে গ্রামগঞ্জের বাজারে বাজারে গান করে বেড়ান তিনি। এর বিনিময়ে পাওয়া টাকা দিয়ে চলে তাঁদের সংসার।

নুর নবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দুই চোখের আলো নেই। আল্লাহ পাক আমাকে গানের গলা দিয়েছেন। আমি দুর্গাপুর ইউনিয়নের উত্তর গোবধা গ্রামের ওস্তাদ কমল সরকারের কাছে সংগীতের তালিম নিয়েছি। দোতারা আর হারমোনিয়াম বাজাতে শিখেছি। এর পাশাপাশি সাত থেকে আট ধরনের শারীরিক কসরত শিখেছি। সেগুলো প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করি, বিনোদন দিই। তাঁরা খুশি হয়ে যৎসামান্য সম্মানী দেন। তাই দিয়ে নয়জনের সংসারের খরচ জোটে।’

দুর্গাপুর ইউনিয়নের লোকজনের কাছে প্রতিবন্ধী পরিবারটি পরিচিত। বিশেষ করে শিল্পী হিসেবে নুর নবীকে চেনেন অনেকেই। সম্পদ বলতে পরিবারটির আছে ১০ থেকে ২ শতাংশ জমির ওপর তৈরি টিনের বাড়ি। পরিবারের মধ্যে নুর নবীর মা নুর জাহান বেগম ও ছোট ভাই সুমন ইসলাম (১২) স্বাভাবিক আছে। নুর জাহান গ্রামের মানুষের বাড়িতে কাজ করে সামান্য আয়-রোজকার করেন। আর সুমন তার বড় ভাই নুর নবীকে বিভিন্ন হাটবাজারে নিয়ে যায়, পথ দেখাতে সাহায্য করে।

নুর জাহান বলেন, তাঁর বড় ছেলে নুর নবীর গানের গলা ভালো, দোতরা আর হারমোনিয়াম বাজায়, হাটবাজারে যায়। কিন্তু রোজার এক মাস মানুষ গান শুনতে চায় না, আর বর্ষাকালে তিন মাস পানির জন্য হাটবাজারে যাওয়া কঠিন। সে সময়ে তাঁদের খুব কষ্ট হয়, ধারদেনা করে চলতে হয়। তাঁরা গরিব মানুষ। ধারের টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে প্রায়ই দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়।

দুর্গাপুর ইউনিয়নের দীঘলটারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম ফারুক বলেন, নুর নবীর সংসারে অভাব আছে, জমিজমা তেমন একটা নেই, শুধু বাড়ির ভিটা। পরিবারের নয়জনের মধ্যে সাতজনই প্রতিবন্ধী। কিন্তু তাঁরা কেউ ভিক্ষা করতে রাজি নন, কারও কাছে হাত পাতেন না। মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চান তাঁরা। তিনি বলেন, এই সংসারের হাল ধরেছে নুর নবী, যিনি নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তবে সংগীতশিল্পী। তাঁর সামান্য আয়ে সংসার চলে কোনো রকমে।

আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জিআর সরওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, নুর নবীর বাবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এন্তাজুল হকের পরিবারের পাঁচ সদস্যের প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড আছে। আরও দুজনের প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।