এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর কলেজে ভর্তির আবেদনে পাঁচটি পছন্দের নাম উল্লেখ করেছিল সাদ আবরাহ। ৩ জুন প্রকাশিত ফলাফলে নটর ডেমে ভর্তির জন্য বিবেচিত হয় সে। ভর্তির শেষ সময় দেওয়া হয় ৬ জুন। প্রয়োজন ছিল ২১ হাজার ১৩৫ টাকা। অল্প সময়ে এত টাকা জোগাড় করতে না পেরে বাধ্য হয়ে মা নাজমা বেগম ১৮ হাজার টাকায় নিজের কানের দুল বিক্রি করে দেন। বাকি টাকা দেয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
মেধাবী শিক্ষার্থী সাদের কলেজে ভর্তি নিশ্চিত হলেও ঢাকায় থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বাবা আনিসুজ্জামান। তাঁদের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী ইউনিয়নের অভয়পুর গ্রামে। রংপুরের বদরগঞ্জের লাবনী আক্তার, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের সাদিয়া সুলতানা ও সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার অনিশ কুমার মাহাতোর গল্পও প্রায় একই রকম। পড়াশোনা করে অভাবের সংসারে হাসি ফোটাতে চায় তারা।
কলেজে ভর্তি হলেও দুশ্চিন্তা কাটছে না
সাদ আবরাহ চলতি বছর শেরপুরের কুহাকান্দা এস হক উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। নালিতাবাড়ী উপজেলার অভয়পুর গ্রামের আনিসুজ্জামান-নাছিমা দম্পতির দুই মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে সাদ সবার ছোট।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনিসুজ্জামান বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ২০২০ সালে হঠাৎ তাঁর ডান পা অবশ (পক্ষাঘাতগ্রস্ত) হয়ে যায়। এক মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তত দিনে চাকরি হারান। এর পর থেকে বাড়িতে বাড়িতে শিক্ষার্থীদের টিউশনি করিয়ে তিনি সংসার চালান।
সাদ আবরাহ মুঠোফোনে বলে, তার বুয়েটে পড়ার খুবই ইচ্ছা। সুযোগ পেলে লেখাপড়া করে একজন প্রকৌশলী হতে চায়।
প্রাইভেট পড়িয়ে লাবনীর জিপিএ–৫
বাড়ি থেকে হেঁটে দেড় কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে পড়েছে লাবনী আক্তার। ছিল না ভালো খাবার, ভালো কাপড়। নিজের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন গ্রামের শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে। মেধাবী লাবনী এবার বদরগঞ্জ উপজেলার শেখেরহাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ–৫ পেয়েছে।
লাবনী আক্তারের বাবার নাম লেবু মিয়া। মা জান্নাতি বেগম। দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে লাবনী বড়। বাবা আগে রিকশা–ভ্যান চালালেও শরীর না কুলানোয় এখন স্থানীয় একটি হিমাগারে শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁর মা জান্নাতী বেগম মানসিক রোগী। আবাদি কোনো জমি নেই। আছে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুই শতক বসতভিটা।
লাবনী আক্তার বলে, তার পড়াশোনার খরচ জোগানোর কোনো টাকা বাবার নেই। কেউ সহযোগিতা করলে সে এইচএসসির পরে আইন বিষয়ে পড়তে চায়।
সাদিয়ার স্বপ্ন মানুষের সেবা করা
সাদিয়া সুলতানা মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঝাঁটিবুনিয়া গ্রামের মেয়ে। সে ঝাঁটিবুনিয়া মোজাফ্ফর ইসহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ২০১৭ সালে সাদিয়া যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত, তখন তার বাবা মকবুল সিকদার অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যান। ছোট সাদিয়া তখন থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে চিকিৎসক হওয়ার।
ছোট একটি চায়ের দোকানের আয় দিয়ে চলত সাদিয়ার মা–বাবাসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারের ব্যয়। বাবা মারা যাওয়ার পর মা রহিমা সুলতানা সংসারের হাল ধরেন। মাত্র ৭ হাজার টাকা বেতনে স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে তিন সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন।
পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চায় অনিশ
রায়গঞ্জের ধুবিল ইউনিয়নের শ্যামেরঘোন গ্রামের হীরেন্দ্রনাথ মাহাতো ও অনিতা রানী মাহাতোর প্রথম সন্তান অনিশ কুমার মাহাতো। সে সিরাজগঞ্জ সরকারি বিএল হাইস্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, হীরেন্দ্রনাথ মাহাতো একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করতেন। হঠাৎই চাকরিটা চলে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েন। এরপর জেলা শহর সিরাজগঞ্জ থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামে চলে আসেন তিনি। পড়ালেখার জন্য অনিশ রয়ে যায় জেলা শহরেই।
অনিশ কুমার মাহাতো বলে, পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাবার এমন দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াতে চায় সে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, নালিতাবাড়ী, শেরপুর, বদরগঞ্জ, রংপুর, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী ও রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ]