বগুড়ায় শতবর্ষী মাঠ বিক্রি নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, হুমকি ও হামলা
বগুড়া শহরের দক্ষিণ কাটনারপাড়া আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন শত বছরের পুরোনো খেলার মাঠ রক্ষা নিয়ে শঙ্কায় এলাকাবাসী। মাঠের অর্ধেক অংশের মালিকানা টিনপট্টি শ্রী শ্রী নারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরের নামে। মাঠের বাকি অংশের মালিকানা বিদ্যালয়ের। মন্দির কমিটির কয়েক নেতা ওই মাঠ বিক্রি করে দেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, বিদ্যালয়সংলগ্ন মাঠে দীর্ঘদিন এলাকার শিশু-কিশোর ও তরুণেরা খেলাধুলা করে। মন্দির কমিটি খেলাধুলার জন্য মাঠটি এত দিন সবার জন্য উন্মুক্ত রাখলেও প্রায় এক বছর ধরে কমিটির একাংশ মাঠটি বিক্রির তৎপরতা চালাচ্ছেন। তবে অন্য অংশ চায় না মাঠটি বিক্রি হোক। এমতাবস্থায় মাঠ রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন এলাকাবাসী।
নতুন করে মাঠটি বিক্রির তৎপরতার অভিযোগ এনে দক্ষিণ কাটনারপাড়াবাসী ছাড়াও মন্দির কমিটির একাংশ আন্দোলন শুরু করেছে। গত বুধবার শহরের সাতমাথায় মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন এলাকাবাসী। মাঠ রক্ষার দাবিতে তাঁরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৫২ সালে শহরের দক্ষিণ কাটনারপাড়া মৌজায় ২৩ শতক জায়গায় জয়গুরু প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা নামের এক ব্যক্তি। পরে বিদ্যালয়টি ‘আইডিয়াল প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে নামকরণ করা হয়। বিদ্যালয়সংলগ্ন ৪৯ শতক জায়গার মালিক ছিলেন দিনাজপুরের জমিদার রাজেন্দ্র কুমার খাসনবিস। ১৯৫৪ সালে নিলাম ডিক্রি পান জ্যোতিশ চন্দ্র ভাদুরী। ১৯৫৭ সালে শ্রী শ্রী নারায়ণ বিগ্রহ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জ্যোতিশ চন্দ্র ভাদুরী পুরো সম্পত্তি মন্দিরের নামে দানপত্র করে দেন। মন্দির কমপ্লেক্সের বাইরে আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন ১২ শতক জায়গা মন্দির কমিটির মৌখিক সম্মতিতে খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা. নাছিমা আকতার বলেন, বিদ্যালয়ে শতাধিক শিক্ষার্থী ও সাত শিক্ষক আছেন। বিদ্যালয় চত্বরে মাঠের অর্ধেক অংশ মন্দিরের সম্পত্তি হলেও সেখানে শিক্ষার্থী ছাড়াও মহল্লার শিশু-কিশোরেরা খেলাধুলা করে। প্রেসপট্রির বাসিন্দা ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী তৌহিদ কামাল হিমাদ্রি বলেন, ‘মাঠে আমরা সারা বছর ফুটবল, ক্রিকেট খেলি। যেকোনো মূল্যে আমরা মাঠ রক্ষা করব।’
টিনপট্টি নারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরের সেবায়েত রঘুনাথ সিং প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা ও ভাই মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন। এখন আমি সেবায়েতের দায়িত্ব পালন করছি। তিন পুরুষ ধরেই মন্দিরের ১২ শতক জায়গা বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। কয়েক পুরুষ ধরেই মহল্লার হিন্দু-মুসলিম শিশু-কিশোরেরা এখানে খেলাধুলা করে। পূজার সময় মন্দিরের দর্শনার্থীরা মাঠে ভিড় করেন। আবার মুসলমানদের ধর্মীয় সভাও এ মাঠে হয়। এটি শুধু খেলার মাঠ নয়, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির অনন্য মিলনস্থল। মন্দিরের সম্পত্তি হলেও খেলার মাঠ বিক্রির বিপক্ষে এলাকাবাসী।
১৯৮৫ সাল থেকে নারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন দক্ষিণ কাটনাপাড়া এলাকার বাসিন্দা চপল সাহা। তিনি বলেন, বছরখানেক আগে বিদ্যালয়সংলগ্ন মন্দিরের জায়গা বিক্রির তৎপরতা শুরু হয়। সর্বশেষ কয়েক দিন আগে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মকবুল হোসেন মুঠোফোনে মাঠের জায়গা বিক্রির কথা বলেন। বিনিময়ে ব্যক্তিগতভাবে কিছু টাকা দেওয়ার কথাও বলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
চপল সাহার অভিযোগ, খেলার মাঠ বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় মন্দির কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বগুড়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তরুণ কুমার চক্রবর্তী তাঁকে হুমকি দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ভাড়াটে ক্যাডার এনে মহল্লায় সশস্ত্র মহড়া দিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘খেলার মাঠ রক্ষায় মহল্লার হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধ। আমরা যেকোনো মূল্যে মাঠটি রক্ষা করব।’
এদিকে খেলার মাঠ রক্ষায় মানববন্ধন করার এক দিন পর গতকাল মাঠ রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নিয়াজুল ইসলামের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য তিনি কাউন্সিলর তরুণ কুমার চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর তরুণ।
নিয়াজুল ইসলাম বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় জানে সাবা হাউজিং এলাকায় ২০-২৫ জন সন্ত্রাসী দেশি অস্ত্র, লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক নিয়ে তাঁর ওপর হামলা করে। তারা তাঁকে বেধড়ক পেটায়। দৌড়ে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান তিনি। রাতে মহল্লায় এসে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে। হামলাকারীরা সবাই কাউন্সিলর তরুণ চক্রবর্তীর লোকজন। তিনি জানান, মাঠটিতে শিশু-কিশোরেরা সারা বছর খেলাধুলা করে। শত বছরের পুরোনো মাঠে তাঁরা খেলাধুলা করে বড় হয়েছেন। বর্তমানে নতুন প্রজন্ম সেখানে খেলাধুলা করছে। যেকোনো মূল্যে শত বছরের খেলার মাঠ রক্ষা করবেন এলাকাবাসী।
অভিযোগের বিষয়ে মন্দির কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক কাউন্সিলর তরুণ কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইডিয়াল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমিও পড়েছি। ওই মাঠে খেলাধুলা করেছি। আমিও মাঠ রক্ষার পক্ষে। মাঠ বিক্রি নিয়ে মন্দির কমিটির সভাপতিকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। এ ছাড়া মাঠ রক্ষা কমিটির আহ্বায়কের ওপর হামলার ঘটনা পুরোটাই নাটক।’
মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার বলেন, বিদ্যালয়সংলগ্ন ১২ শতক জায়গা টিনপট্টি শ্রী শ্রী নারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরের। সেটি খেলার মাঠ নয়। সেখানে অবৈধভাবে ক্লাবঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এ সম্পত্তি কম দামে বিক্রির জন্য কয়েক দিন আগে সভাপতিই প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এখন তিনি উল্টো মাঠ রক্ষার নামে তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।
বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনেও মাঠটি রাজনীতির সূতিকাগার ছিল। ঐতিহ্যবাহী ওই মাঠ ঘিরে অনেক স্মৃতি আছে। মাঠটি কাউকে দখল বা বিক্রি করতে দেওয়া হবে না। দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শত বছরের পুরোনো মাঠটি রক্ষা করা হবে।