প্রবল বৃষ্টির এক সন্ধ্যায় প্রসবব্যথা ওঠে ফাতেমা বেগমের। পল্লিচিকিৎসক হাসপাতালে নিতে বলেন। কিন্তু বাড়ি থেকে উপজেলার হাসপাতাল ৩০ কিলোমিটার দূরে। কাদামাটির রাস্তায় যানবাহন চলছিল না। নৌপথ একমাত্র উপায়। ঝড়-বৃষ্টির দিনে নৌ চলাচলে সতর্কসংকেত থাকায় রাতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মারা যায় ফাতেমার সন্তান।
গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের কথা এটি। ফাতেমার বাড়ি খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপের সুতারখালী ইউনিয়নে। ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার এই উপজেলার উপকূলের চিত্র বদলে দেয় একেকটি দুর্যোগ। জনপদের বড় সমস্যা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া, বিশেষত, অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি মায়েদের। হাসপাতাল-সংকট ও যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিকূল হওয়ায় প্রাথমিক ও মধ্যম স্তরের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উপকূলের বাসিন্দারা।
জলবায়ুর অভিঘাতে উপকূলে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোটের (ক্লিন) প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূল আরও দুর্যোগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন বেশি হলেও বাস্তবে তা হয় না। বসবাসের ঝুঁকি, সুপেয় পানির সংকটে চিকিৎসকেরাও উপকূলে থাকতে চান না। অতিরিক্ত লবণাক্ততায় হাসপাতালের অবকাঠামোও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
দাকোপ উপজেলার দক্ষিণের শেষ জনপদ শিবসা তীরের কালাবগী ঝুলন্তপাড়া। নদীর চরে গাদাগাদি গড়ে ওঠা অসংখ্য ঝুলন্ত ঘরের সামনে দিয়ে চলার পথ। ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর ঝুলন্তপাড়ায় বসতি গড়ে ওঠে। এরপর সাত-আটবার নদীভাঙনে শিবসা-সুতারখালীর পেটে চলে গেছে বসতঘরের জমি। ঘূর্ণিঝড় সিডর-আইলা-আম্পানের আঘাত সয়ে টিকে আছেন সাড়ে তিন হাজারের মতো বাসিন্দা।
ঝুলন্তপাড়ায় ঘুরে দেখা গেল, এখানে সাইক্লোন শেল্টার নেই। সুপেয় পানি নেই। শিশুরা পুষ্টিহীন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা নেই। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হলে নৌপথে শহরে নিতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল কাদের বলেন, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর স্ত্রীর প্রসবব্যথা উঠলে ট্রলারে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সন্তানের জন্ম হয়। বাচ্চার খিঁচুনি হলে তাকে নিয়ে খুলনার হাসপাতালে ছিলেন ১২ দিন। খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকার বেশি। তাঁর ভাষায়, ‘আমাগো চিন্তার শ্যাষ নি, কখন দুর্যোগ আসে। সকাল হলি খাব কী? পানি কেনব কী দিয়ে? চাল কেনব কী দিয়ে? আমগো মা-বুনিরা গর্ভবতী হলি বড় সমেস্যায় পড়তি হয়। প্যাটের বাচ্চা আর মার জীবন নে অনেক ঝুঁকি থাকে।’
২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে শিবসা-সুতারখালী নদীর কোলে দোল খাওয়া জনবসতি ‘ফকিরকোনা’ কালাবগী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সুন্দরবনঘেঁষা দ্বীপ গ্রামটিতে বিদ্যুৎ নেই, নেই কোনো বিদ্যালয় কিংবা চিকিৎসাসেবার ন্যূনতম সুযোগ। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নিমাই রায় বলেন, এলাকাটি বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে মানুষ দূরের কমিউনিটি ক্লিনিকে যেতে পারতেন। এখন ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হলেও নদী পাড়ি দিতে হয়।
মাতৃস্বাস্থ্যের চিত্র
সুতারখালী ইউনিয়নের ৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১১৭টি শিশুর জন্ম হয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য সহকারীদের দেওয়া তথ্য এটি। প্রথম আলো ১১৭ শিশুর মায়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারের তথ্য বিশ্লেষণ করে পেয়েছে, প্রসূতি মায়ের ৪১ শতাংশের প্রসব হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা খুলনা শহরের কোনো হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। তাঁরা মনে করেন, হাতের কাছে প্রসবকালীন পূর্ণ সেবা পেলে তাদের বাড়তি খরচ করে শহরে যেতে হতো না।
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে শহরের ক্লিনিকে চিকিৎসা করানো স্থানীয় শ্যামল মণ্ডল বলেন, দুর্যোগে এলাকার রাস্তাঘাট ভালো থাকে না। এলাকায় ভ্যান পর্যন্ত চলে না। কমিউনিটি ক্লিনিক অনেক দূরে। গর্ভকালীন সমস্যায় স্ত্রীকে সরাসরি উপজেলার হাসপাতালে নিয়েছিলেন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা নেওয়ার পরও অসুস্থ বোধ করায় স্ত্রীকে খুলনা শহরে নিয়ে চিকিৎসা করতে হয়েছে।
উপকূলের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক ও মধ্যম স্তরের স্বাস্থ্যসেবা অর্থাৎ কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না উপকূলবাসী। চিকিৎসাকেন্দ্রের অপ্রতুলতা, জনবলসংকটসহ নানা কারণে তাঁরা এ স্তরের সেবা পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্যসেবা নিতে তাঁদের টারশিয়ারি স্তরে অর্থাৎ খুলনা শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বেসরকারি হাসপাতালের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। তবে যোগাযোগ প্রতিকূলতায় সেই সেবা উপকূলবাসীর কাছে সহজলভ্য নয়।
কমিউনিটি ক্লিনিকের অপ্রতুলতা
ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা। সুতারখালী ইউনিয়নে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। সে হিসাবে এই ইউনিয়নে অন্তত আটটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা। আছে মাত্র চারটি। বাকি ইউনিয়নগুলোর অবস্থাও এমনই।
দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কমিউনিটি ক্লিনিকের কাঠামো নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনাও আছে। সুতারখালী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নির্মাণাধীন কমিউনিটি ক্লিনিকটি আইলার পর দীর্ঘদিন লবণপানিতে ডুবে ছিল। ক্লিনিকটি আর নির্মাণ করা হয়নি।
কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধের অপ্রতুলতাও আছে। ঝুলন্তপাড়ার নীলপদ মণ্ডল বলেন, দীর্ঘক্ষণ লবণপানিতে মাছ ধরার কারণে তাঁর অ্যালার্জির সমস্যা হয়। তিন কিলোমিটার দূরের কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে এই অসুখের ওষুধ চাইলে তাঁরা দিতে পারেননি। তাঁর প্রশ্ন, ‘সেখানে গিয়ে কী হবে?’
প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা। সে হিসাবে দাকোপে থাকার কথা নয়টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। কাগজে-কলমে এগুলো থাকলেও একটিরও অবকাঠামো নেই। এসব কেন্দ্রে নিয়োগ দেওয়া চিকিৎসকেরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্ত থেকে কাজ করেন। উপকূলে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সুবিধা যথাযথভাবে থাকলে স্বাস্থ্যসেবায় সুফল পাওয়া যেত বলে মন্তব্য করেন দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সুদীপ বালা।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র বেহাল
দাকোপে সাতটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র আছে। বাণীশান্তা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সুদৃশ্য ফটক ও সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা এলাকা। ভেতরে জরাজীর্ণ একটি স্থাপনা। ফটকে তালা লাগানো। ওই কেন্দ্রে একসময় সেবা পেতেন এলাকাবাসী। এখন এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের অবকাঠামো কয়েকটি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জনবলসংকটও তীব্র।
সুতারখালী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে একাধিকবার গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে গরু-ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর লবণপানিতে ডুবে থাকায় এই কেন্দ্রের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে। উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তা (এসএসিএমও) ও পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার (এফডব্লিউভি) থাকার জন্য যে আবাসিক কোয়ার্টার আছে, সেটা ভাঙাচোরা। তবে আলী আকবর গাজী নামে ইউপির একজন কর্মচারী সেখানে চার বছর ধরে পরিবার নিয়ে থাকছেন।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে সুতারখালী কেন্দ্রে একজন এফডব্লিউভিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর এখানে থাকার কথা থাকলেও সপ্তাহে তিনি দুই দিন আসেন বলে জানালেন স্থানীয় ব্যক্তিরা, যদিও প্রতিদিনের হাজিরা খাতায় তাঁর উপস্থিতির সই আছে।
এফডব্লিউভি ইরানী সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, এখানে থাকার মতো অবস্থা নেই। সপ্তাহে তিনি তিনবার আসেন। তাঁকে সরিয়ে নিতে কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করেছেন। প্রসূতি মায়েরা এখানে আসেন। অথচ ওজন দেওয়ার মেশিন নেই, একটা থার্মোমিটার পর্যন্ত নেই। প্রসব করানোর ব্যবস্থা তো দূরের কথা; পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটা শয্যাও নেই। রক্তচাপ মেপে কিছু পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেন তিনি।
উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের প্রতিটিতে একজন করে এসএসিএমও থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র একজন। তিনি অন্য একটি কেন্দ্রের দায়িত্বেও আছেন। এসএসিএমও রজত মণ্ডল বলেন, দুর্যোগপ্রবণ প্রত্যন্ত এলাকায় কেউ থাকতে চান না। সুযোগ পেলেই বদলি হওয়ার চেষ্টা করেন।