শরীরে বুলেট নিয়ে দিনরাত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন বোয়ালমারীর রনি

রনি শেখছবি: প্রথম আলো

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার দৈত্যরকাঠি গ্রামের রনি শেখ (২৭)। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন সকালের দিকে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে আহত হন তিনি। আকাশ থেকে আসা বুলেট তাঁর মুখের ভেতর দিয়ে মেরুদণ্ডের হাড়ে বিদ্ধ হয়। দাঁত পড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় জিব ও মুখগহ্বর।

টানা সাড়ে তিন মাস বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন বাড়িতে দিনরাত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রনি। মাসে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে তাঁকে ঢাকায় যেতে হয়। চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে পরিবার। পরিবার, এলাকাবাসী ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়া চিকিৎসার জন্য তেমন কোনো অর্থসহায়তা পাননি। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস পেলেও এখনো সাহায্য পাননি।

রনি শেখ বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের দৈত্যরকাঠি গ্রামের এনামুল হোসেন ও নাজমা বেগম দম্পতির ছেলে। দুই ভাইবোনের বড় রনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাঁর বোন আনিকা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। পৈতৃক ৭ শতাংশ বসতবাড়ি ছাড়া তাঁদের কোনো জমিজমা নেই। ২০২২ সালে কুমারখালীর ধলনগর গ্রামের শান্তা ইসলামের (২৩) সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের ১৩ মাস বয়সী একটি ছেলে আছে।

স্বজন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রনি যমুনা ফিউচার পার্কের কাছে একটি নির্মাণাধীন ভবনের ব্যবস্থাপক ছিলেন। তাঁর বাবা এনামুল হোসেন পূর্ব মণিপুর এলাকায় আরেকটি নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত ছিলেন। ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে অজ্ঞান হন রনি। আন্দোলনকারীরা তাঁকে উদ্ধার করে গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে ছুটে যান বাবা। হাসপাতালে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত জটিল অস্ত্রোপচার করেও গুলি বের করতে ব্যর্থ হন চিকিৎসকেরা। পরে ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ১৮ দিন চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকেন। বিল আসে প্রায় ১৩ লাখ টাকা। ধারদেনা করে ৩ লাখ ১৮ হাজার ওষুধের বিল দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।

পরে সমন্বয়কদের মাধ্যমে সাভার সিআরপি হাসপাতাল হয়ে ঢাকার কল্যাণপুরে ইবনে সিনা হাসপাতালে ২ মাস ৭ দিন চিকিৎসা চলে। হাসপাতালের বিল সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দেয় জামায়াতে ইসলামী। প্রায় তিন মাস বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসার পর প্রাণে বেঁচে গেলেও রনির শরীরের বাঁ অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। মেরুদণ্ডে বিদ্ধ বুলেটের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। অন্যের সাহায্য ছাড়া বিছানা থেকে ওঠা বা হাঁটাচলা করতে পারেন না। স্ত্রীর পাশাপাশি তাঁর বোন তাঁকে সাহায্য করেন।

রনির স্ত্রী শান্তা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চার মাসের বেশি সময় ধরে শরীরে থাকা গুলির যন্ত্রণায় দিনরাত ছটফট করছেন তাঁর স্বামী। তীব্র যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। স্বামীর এ অবস্থা তিনি আর দেখতে পারছেন না। চোখের সামনে যন্ত্রণায় কাতরালেও তিনি কিছুই করতে পারছেন না।

রনির বাবা এনামুল হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে সমন্বয়কেরা এসে নাম ও ঠিকানা নিয়ে উন্নত চিকিৎসাসহ অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। ছেলের চিকিৎসায় মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা ও সাহায্য নিয়ে সাত লাখ টাকা খরচ করেছেন। ঠিকমতো সংসারই চলছে না। এখন চিকিৎসা কীভাবে হবে, তা তিনি জানেন না।

রনি শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় আগারগাঁও এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। এখন বাড়িতে চলে এসেছেন। এলাকাবাসী, আত্মীয়স্বজন ও জামায়াত ছাড়া চিকিৎসা বাবদ আর কেউ সাহায্য করেননি। কর্মহীন হয়ে পড়ায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বড় বিপদে আছেন। কখনো সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন কি না, শঙ্কায় আছেন। তিনি বলেন, ‘শুনেছি আন্দোলনে নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যদের সাহায্য দেওয়া হবে। টেলিভিশনে নানা প্রতিশ্রুতির কথা শুনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমি সরকারের থেকে একটা টাকাও হেল্প পাইনি।’