প্রতিষ্ঠার আড়াই বছরেও সিলেট ওয়াসার কার্যক্রম শুরু হয়নি, নিষ্ক্রিয় চেয়ারম্যান
সিলেট মহানগরে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) গঠিত হয় ২০২২ সালের ২ মার্চ। তিন মাস পর ওয়াসা বোর্ড গঠিত হলেও সদস্যরা এখনো সভায় বসেননি। দেড় বছর পর একজন চিকিৎসককে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হলেও বয়স ও অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি নিষ্ক্রিয়। এখনো স্থাপিত হয়নি কার্যালয়, নিয়োগ করা হয়নি জনবল। এতে ওয়াসা গঠনের আড়াই বছরেও সুফল পাননি নগরবাসী।
সিলেট ওয়াসা নিয়েই নিজেই হতাশা প্রকাশ করেছেন ৭৩ বছর বয়সী চেয়ারম্যান এ কে এম হাফিজ। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ। এক দিন পরপর কিডনি ডায়ালাইসিস নিচ্ছি। আজকে ৭-৮ মাস ধরে এমন অবস্থা। কথা বলতেও টায়ার্ড হয়ে যাই।’
এ কে এম হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে চেয়ারম্যান করছিল, আমি জয়েন করে আসছিলাম। এরপর কোনো কার্যক্রম দেখি নাই। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীকে বলেছিলাম, ওয়াসার বিষয়ে আপনি একটু দৌড়াদৌড়ি করেন। এরপর তো গন্ডগোল (ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান) চলে এল। এখন আমি অসুস্থ হয়ে গেছি। ওয়াসার দায়িত্ব নেওয়ার মতো অবস্থাতে আমি নেই।’
ওয়াসা-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিলেটের নাগরিকদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পানি সরবরাহ ও নর্দমা ব্যবস্থাপনায় ২০২২ সালের ২ মার্চ দেশের পঞ্চম ওয়াসা হিসেবে সিলেট ওয়াসা প্রতিষ্ঠা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ওই দিন পৃথক আরেকটি স্মারকে সিলেট ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত নগরের পানি সরবরাহ কার্যক্রম বর্তমানের মতো সিলেট সিটি করপোরেশনকে অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ না হওয়ায় এখনো সিটি কর্তৃপক্ষই পানি সরবরাহ করছে।
ওয়াসা গঠনের প্রায় তিন মাসের মধ্যে ওয়াসা বোর্ডের সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ৫ জুন থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত চার ধাপে ১১ সদস্যবিশিষ্ট বোর্ড গঠিত হয়। পরে গত বছরের ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক এ কে এম হাফিজকে বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের ভাগনি জামাই। নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকার এই বাসিন্দা এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও নাক কান গলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে এখন অবসরে আছেন। দুই মেয়াদে বিএমএ সিলেট জেলার সভাপতি ছিলেন। আবদুল মোমেন সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি হিসেবে সিলেট ওয়াসা বোর্ডের সদস্য হন সিলেটের বিশিষ্ট আইনজীবী এ এফ মো. রুহুল আনাম চৌধুরী। ওয়াসা গঠনের পর এখন পর্যন্ত কোনো সভা হয়নি বলে তিনি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সিলেট ওয়াসার কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। কার্যক্রম শুরু হলে শহরের মানুষ অনেক উপকৃত হবেন। তিনি দ্রুত কার্যক্রম শুরুর তাগিদ দেন।
নগরের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, বিভাগীয় শহর হিসেবে সিলেটে দিনে দিনে জনসংখ্যা বাড়ছে। যথাযথ সুপেয় পানির সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ওয়াসা গঠন জরুরি ছিল। দুই বছর আগে ওয়াসা গঠিত হলেও কার্যক্রম শুরু না হওয়ার তাঁরা হতাশ।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ১৮৭৮ সালে পৌনে দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত সিলেট পৌরসভা ২০০২ সালে সিটি করপোরেশনের উন্নীত হয়। পরিধি বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার। ২০১৪ সালে আয়তন আরও বড় করার উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। এরপর ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট সিটি করপোরেশন সম্প্রসারণ করে ২৭টি ওয়ার্ড থেকে ৪২টি করা হয়। নগরের এখনকার আয়তন সাড়ে ৭৯ বর্গকিলোমিটার। বাসিন্দা প্রায় ১০ লাখ।
বাগবাড়ি এলাকার আমজাদ হোসেন বলেন, তাঁর এলাকায় পানির সমস্যা আছে। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, ওয়াসা হলে সমস্যার সমাধান হবে। অথচ ওয়াসা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ দুই বছরেও কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় তাঁরা হতাশ। দ্রুত কার্যক্রম শুরুর দাবি জানিয়েছেন তিনি।
সিটি করপোরেশনের পানি শাখা জানায়, পুরোনো ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৪টিতে সিটি কর্তৃপক্ষ পানি সরবরাহ করছে। বর্ধিত ১৫টি ওয়ার্ডে পানির সঞ্চালন লাইন এখনো স্থাপিত হয়নি। ২৪টি ওয়ার্ডে দৈনিক সাড়ে ৮ কোটি লিটার চাহিদার বিপরীতে সিটি করপোরেশন পানি দিচ্ছে ৫ কোটি লিটার। এ ছাড়া ৪২টি ওয়ার্ডে দৈনিক পানির চাহিদা সাড়ে ১২ কোটি লিটার।
সূত্র অনুযায়ী, নগরের বর্ধিত অংশে আধুনিক কোনো নালা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। প্রাকৃতিকভাবে যেসব নালা-খাল আছে, সেভাবেই চলছে। পানি সরবরাহেরও কোনো ব্যবস্থাই নেই। এসব বর্ধিত অংশের বাসিন্দারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুকুর, গভীর নলকূপসহ নানা মাধ্যম থেকে পানি সংগ্রহ করেন।
ওয়াসা-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সিলেট ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পান সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান। এরপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে তিনটি দায়িত্ব দিয়ে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেয়। দায়িত্বগুলো হলো সিলেট ওয়াসার অর্গানোগ্রাম তৈরি, সিটি করপোরেশনের বিদ্যমান পানি শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে কীভাবে ওয়াসা চালু করা যায়, সে সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রদান ও সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহ শাখার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে জানানো।
জানতে চাইলে নূর আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী যাবতীয় তথ্য লিখিতভাবে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তবে দ্রুত ওয়াসার কার্যালয় স্থাপন ও লোকবল নিয়োগ না দিলে পানিসংকট দূর ও নর্দমা ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করা অসম্ভব।