মঙ্গলবার সকাল ৯টা। আকাশ ভেঙে শুরু হয় বৃষ্টি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির তীব্রতাও বৃদ্ধি পায়। ভারী বর্ষণে ধীরে ধীরে পানি জমতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে নালা-নর্দমা উপচে পানি চলে আসে সড়কে। দুপুরের মধ্যে তা রূপ নেয় জলাবদ্ধতায়।
শুধু চট্টগ্রাম নগর নয়, জলাবদ্ধতায় ডুবেছে নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় গত সোমবার পানি থাকলেও গতকাল মঙ্গলবার তা অনেকটাই নেমে গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্তব্যরত আবহাওয়াবিদ ইসমাইল ভূঁইয়া বলেন, পাঁচ-ছয় দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টার পর থেকে বৃষ্টি বেড়েছে। আরও কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। পাহাড়ধসের সতর্কতা জারি রয়েছে।
গতকাল বেলা একটায় নগরের মুরাদপুর সড়কের ওপর কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমরসমান পানি দেখা যায়। ফুটপাত দিয়েও হাঁটার সুযোগ ছিল না। ডুবে যায় ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, ডিসি সড়ক, চকবাজার, ফুলতলা, কে বি আমান আলী সড়ক, ওমর আলী মাতব্বর সড়ক, বাড়ই পাড়া, বাকলিয়া, গোলপাহাড়, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ, হালিশহর আবাসিক এলাকা, চান্দগাঁও, খাজা সড়ক, একে খান ইস্পাহানী সি গেট।
বারবার জলাবদ্ধতার কারণে ব্যবসার ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান মুরাদপুরে অবস্থিত আইপিএস, ব্যাটারি ও টায়ার দোকান বিসমিল্লাহ অটো ইলেকট্রিক সার্ভিসের ব্যবস্থাপক একরামুল হক। তিনি বলেন, একটু ভারী বৃষ্টি হলেও দোকানে পানি ঢুকে যায়। সকালে দোকান খুলতে এসে দেখেন ভেতরে পানি। বেলা আড়াইটার দিকে পানি নামে। এরপর দোকান পরিষ্কার করতে সময় লেগেছে দেড়-দুই ঘণ্টা। এসব কারণে কোনো বেচাকেনাও হয়নি।
চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন কল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’–এর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টিতে নগরের কিছু এলাকায় পানি জমেছে। তবে বৃষ্টি থামার পর তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নেমে গেছে।
এদিকে চট্টগ্রামের রাউজানে টানা ভারী বর্ষণে হালদা ও কর্ণফুলী নদীর পানি পাঁচ–ছয় ফুট বেড়ে যাওয়ায় তীরবর্তী অন্তত ২০টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। ভেঙে পড়ছে রাস্তাঘাট, বসতঘর। পাশাপাশি তলিয়ে গেছে ফসল ও মাছের চাষ করা পুকুর। পানিতে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব গ্রামের বাসিন্দারা।
স্কুল ছুটি
টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীসহ নয়টি উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। গতকাল সকালে জেলার বিভিন্ন বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, পানিবন্দী মানুষের জন্য শুকনা খাবার ও কিছু নগদ অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা জজ আদালত আঙিনা, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনের সড়ক, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ভবন, নোয়াখালী প্রেসক্লাব ভবনের নিচতলা জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া জেলা শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হরিনারায়ণপুর, কৃষ্ণরামপুর, উত্তরহাট, কাজী কলোনি, মাস্টারপাড়া, সোনাপুরসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় সব কটি সড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। প্লাবিত হয়েছে অনেক আধা পাকা বসতঘর। চৌমুহনী-মাইজদী-সোনাপুর চার লেন সড়কের টাউন হল মোড়, জামে মসজিদ মোড়সহ কয়েকটি অংশে পানি ওঠায় আশপাশের দোকানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীতে অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফেনী-পরশুরাম সড়কের কয়েকটি স্থানে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
পাহাড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
রাঙামাটির সদর উপজেলার সাপছড়ি ইউনিয়নে পাঁচ গ্রামে পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গিয়ে অন্তত ৪০ পরিবারের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঘাইছড়ি উপজেলার কাচালং নদীতে পানি বেড়ে চলেছে। পানির উচ্চতা বাড়লে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে।
খাগড়াছড়িতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে পাহাড়ধস। জেলা শহরের শালবন ও কুমিল্লা টিলা এলাকায় বসতঘরের পাশে পাহাড়ধস হয়েছে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গতকাল দুপুরে খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, চেঙ্গী নদী, খাগড়াছড়ি ছড়া ও মধুপুর ছড়ার পানি বেড়ে মুসলিমপাড়া, কালাডেবা, বটতলী, গঞ্জপাড়া, শান্তি নগর, শব্দমিয়াপাড়া, ফুটবিল, এপিবিএন, মিলনপুর, খবংপুড়িয়াসহ কয়েকটি এলাকার বাড়িঘর ডুবে গেছে।
দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেডকোয়ার্টার, জোড়াব্রিজসহ চারটি এলাকায় রাস্তা ডুবে যাওয়ায় রাঙামাটির লংগদু ও বাঘাইছড়ির সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। দীঘিনালার মেরুং, বাবুছড়া ও কবাখালী ইউনিয়নের প্রায় ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।