কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালী সেতুর দক্ষিণে বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) তৈরি করা প্যারাবনের ১০ থেকে ১২ হাজার গাছ কেটে চিংড়ির ঘের নির্মাণের অভিযোগের তদন্তে প্রকৃত দখলদারদের নাম বাদ দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা ও পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিদর্শক ফাইজুল কবির আদালতে এই প্রতিবেদন দেন।
গত ১৪ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘেরের বাঁধ’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমে প্যারাবন কেটে চিংড়ির ঘের নির্মাণের খবর প্রকাশের পর ১৭ জানুয়ারি চকরিয়া উপজেলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহিদ হোসাইন স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা করেন। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ৩০ দিনের মধ্যে আদালত প্রতিবেদন দিতে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিচালককে নির্দেশ দেন। এর প্রায় আট মাস পর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালী উপকূলে কয়েক শ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। এরপর জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য বদরখালী নদীতীরের ৩ কিলোমিটারজুড়ে ১৯৯৬, ২০০০, ২০০৩ ও ২০১৯ সালে ৪ দফায় অন্তত ৪০ হাজার কেওড়া ও বাইন গাছের চারা রোপণ করে বেসরকারি সংস্থা উবিনীগ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গাছগুলোর উচ্চতা দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৫ ফুট। কিন্তু এলাকার রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় শতাধিক দখলদার কয়েক দফায় হাজারো গাছ কেটে চিংড়ির ঘের নির্মাণ করেন। দখলদারদের সবাই কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের অনুসারী।
আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বদরখালী নদীসংলগ্ন প্যারাবনের ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০ মিটার প্রস্থের জায়গাতে অন্তত ২০০ বাইন ও কেওড়া গাছ কাটা হয়েছে। এরপর সেখানে চিংড়ির ঘের নির্মাণের জন্য দুই ফুট উচ্চতার একটি বাঁধ দেওয়া হয়। প্যারাবন নিধনের ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন ও ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, যা কোনোভাবেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। প্রতিবেদনে প্যারাবন নিধনের সঙ্গে জড়িত ১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
উবিনীগের আঞ্চলিক সমন্বয়ক জয়নাল আবেদিন খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকাশ্যে শতাধিক লোক প্যারাবনের ১০ থেকে ১২ হাজার গাছ কেটে নিয়েছিলেন। তখন প্রথম আলোসহ বিভিন্ন দৈনিকে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তদন্ত চলাকালে উবিনীগের পক্ষ থেকে প্যারাবন নিধনে জড়িত প্রায় ৪০ জনের একটি তালিকা এবং প্যারাবন নিধনের ভিডিও চিত্র পরিবেশ অধিদপ্তরে সরবরাহ করা হয়েছিল। ভিডিওতে প্যারাবন নিধনকারী ব্যক্তিদের সহজে শনাক্ত করা যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের (সাক্ষী) নামও সংগ্রহ করা হয়েছিল। এরপরও প্রকৃত দখলদারদের নাম বাদ দিয়ে নিরীহ ও দরিদ্র ১৩ জনের নামে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
জয়নাল আবেদিন খান আরও বলেন, নিরীহ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনায় এলাকায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে উবিনীগের পক্ষ থেকে নারাজি আবেদন করে পুনরায় তদন্ত চাওয়া হবে।
উবিনীগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা ৪০ জন দখলদারের তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী জাফর উল্লাহ, আহমদ উল্লাহ, আবদুল কাদের, মোহাম্মদ মুজিব, নাছির উদ্দিন, সেলিম উল্লাহ, জকির আহমদ প্রমুখ। সবাই সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের অনুসারী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে প্যারাবন নিধনের ঘটনায় যে ১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁরা কেউ লবণচাষি, কৃষক, নৈশপ্রহরী ও দোকানের কর্মচারী।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজন রিদুওয়ান হোসেন বদরখালী বাজারের একটি দোকানের কর্মচারী। তিনি বলেন, প্যারাবন নিধনের ঘটনায় তিনি মোটেও জড়িত নন। প্রকৃত দখলদারদের আড়াল করতে তাঁর নাম প্রতিবেদনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই কথা বলেন অভিযুক্ত আরেকজন আলী আজম।
স্থানীয় লোকজন জানান, বদরখালী ইউনিয়নের সব জমি বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতির আওতাধীন। বদরখালী ইউনিয়নকে সমিতির পক্ষ থেকে ৯টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়। লটারির মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডকে একটি করে মাছের ঘের বরাদ্দ দেওয়া হয়। বদরখালী সেতুসংলগ্ন মাছের ঘেরটি ছনুয়াপাড়া লটারি ঘের নামে পরিচিত। এই ঘেরের অংশীদার ২৯ জন। ছনুয়াপাড়া লটারির লোকজনই উবনীগের প্যারাবন কেটে চিংড়ির ঘের তৈরি করেন। দখলে নেতৃত্ব দেন ছনুয়া লটারির সভাপতি জাফর উল্লাহ। তবে জাফর উল্লাহ দাবি করেন, তিনি দখলের ঘটনায় জড়িত নন। তাঁদের হাজার দেড়েক সদস্য রয়েছেন। তাঁরাই মাছের ঘের করতে প্যারাবন নিধন করেছেন।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ফাইজুল কবির বলেন, সরেজমিন অনুসন্ধান করে প্যারাবন নিধনের সঙ্গে তিনি যাঁদের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন, তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে।
উবিনীগের পক্ষ থেকে যাঁদের তালিকা জমা দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাঁদের সম্পৃক্ততার বিষয়েও কেউ সাক্ষ্য দেয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, ইতিমধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাও অন্য জায়গায় বদলি হয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে নিরীহ কাউকে জড়ানো হলে তাঁর করার কিছু নেই। তবে আদালত থেকে পুনরায় তদন্তের আদেশ দিলে সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।