‘পুলাডাই আমার খরচ দিত, সেই পুলাডারেই গুলি করে মারল’
বড় দুই ছেলে স্ত্রী-সন্তানসহ আলাদা থাকলেও বিধবা মা সুফিয়া বেগমের (৫৫) ভরণপোষণের দায়িত্ব এড়াতে পারেননি ছোট ছেলে মো. আবুজর শেখ (২৩)। মায়ের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন এ তরুণই। গত ১৯ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। আহত অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর একটি হাসপাতালে।
খবরটি শোনার পর সুফিয়ার মাথার ওপর সেদিন যেন গোটা আকাশটা ভেঙে পড়েছিল। তবু আশার প্রদীপ জ্বেলে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এক সপ্তাহের বেশি সময় চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২৭ জুলাই রাত ১০টার দিকে আবুজরের মৃত্যু হয়। ছেলেকে হারিয়ে চারদিকে এখন কেবল অন্ধকার দেখছেন মা।
‘সংসারে সব সুময় অভাব লাগিই থাকত। বহু কষ্টে পুলাপানগুলারে মানুষ করছি। আমার আবুজরের বয়স যহন ছয়, তহন ওর বাপে মরে গেল। তহন থেকে কী যে কষ্ট করছি। ভাবছিলাম, পুলাগুলা বড় হইয়্যা আমার কষ্ট দূর করব। তিন পোলা ও এক মাইয়্যার মধ্যে সবার ছোট আমার আবুজর। অন্য পোলারা আলাদা হয়ে গেছে। ছোডো পুলাডাই আমার দেখাশোনা, খাউন-দাউন ও ওষুধের খরচ দিত। আর সেই পুলাডারেই গুলি করে মারল!’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা গলায় কথাগুলো বলছিলেন সুফিয়া বেগম। কোনো সান্ত্বনাতেই তাঁর আর্তনাদ থামছিল না।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে আবুজরের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের পশ্চিম শ্যামপুর এলাকায় সরেজমিন এ দৃশ্য দেখা গেছে। সেখানে তাঁর পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, সংসারের দারিদ্র্য ঘোচাতে প্রায় সাত বছর আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন আবুজর। সর্বশেষ তিনি বসুন্ধরা এলাকায় এক ব্যক্তির প্রাইভেট কারের চালক হিসেবে কাজ করতেন।
ঘটনা প্রসঙ্গে আবুজরের বড় ভাই শাহিদুল বলেন, গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় মুঠোফোনে এক ব্যক্তি কল করে জানান আবুজরের পেটে গুলি লাগছে। পরে ওই রাতেই রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে যান তাঁরা। সেখানে চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দেন। রাতে অস্ত্রোপচারের পর আবুজরের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। এবার চিকিৎসকেরা অন্য হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী তাঁকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আবারও অস্ত্রোপচার করার জন্য বলেন চিকিৎসকেরা। সেটি করালে আবুজরের শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়। পরে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর ভাই আর বেঁচে নেই।
অবিবাহিত ছেলেকে হারিয়ে মা সুফিয়ার আর্তনাদ যেন থামছেই না। ছেলের স্মৃতি মনে করে তাঁর কথাই বারবার বলছিলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যায় খবর আসে আমার পুলার পেটে গুলি লাগছে। এই কথা শোনার পর থেকেই আমার আর খাউন-দাউন নাই; সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। ৯ দিন পুলাডা হাসপাতালে ছিল। কতই না আল্লাহরে ডাকলাম, আল্লাহ পুলাডারে রাইখা যাও।’
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন আবুজরের মা, ‘হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার পুলা, আমাকে বলছে—কষ্ট করে হইলেও চিকিৎসা করাও, ভালো হয়ে সব টাকা দিয়ে দিমু সবাইকে। কত কষ্ট করে টাকা-পয়সা মিল করে, পুলার চিকিৎসা করাইলাম, তবু তো পুলারে ফিরত আনতে পাল্লাম না।’
এ ঘটনায় ন্যায়বিচার পাবেন কি না জানেন না আবজরের মা সুফিয়া বেগম। তবে প্রশ্ন রাখেন, ‘আমার পুলা কার কী ক্ষতি করছিল? যে পুলা মার জন্য পাগল, সেই পুলা কারও ক্ষতি করতে পারে না। পুলারে গুলি কইরা কেন মারতে হইছে?’