‘রাষ্ট্র এখনো ব্যস্ত কীভাবে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়া যায়’

কোটা আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে গুম, খুন, নির্যাতন ও আটকের প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার দুপুরে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করেছেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর ব্যানারে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরাছবি: শামসুজ্জামান

‘কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে হত্যাকাণ্ডের দায় রাষ্ট্র আজও স্বীকার করেনি। রাষ্ট্র এখনো ব্যস্ত কীভাবে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়া যায়। রাষ্ট্র আজ মেকি কান্না কাঁদছে। রাষ্ট্র শোক ঘোষণা করেছে অথচ এখনো শহীদের প্রকৃত সংখ্যা মানতে তাদের কষ্ট হয়। প্রকৃত শহীদদের শনাক্ত করতে রাষ্ট্রের এখন পর্যন্ত টনক নড়েনি।’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে গুম, খুন, নির্যাতন ও আটকের প্রতিবাদে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করেছেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর ব্যানারে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা। মিছিল শেষে এক সমাবেশে এসব কথা বলেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদা আকন্দ।

কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কয়েক দিনে নিহতের ঘটনাগুলোকে ‘জুলাই গণহত্যা’ নামে অভিহিত করে অধ্যাপক মাহমুদা আকন্দ বলেন, ‘এখনো রাষ্ট্রের ভেতরে কোনো মায়া জাগছে না। আমি রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে চাই, যাঁরা বলছেন উন্নয়নের জন্য এই আন্দোলন হচ্ছে সহিংস আন্দোলন, তাঁদের বলছি, আপনারা কাদের জন্য উন্নয়ন করছেন? যাদের জন্য উন্নয়ন করছেন, তারা রাস্তায় গুলি খেয়ে মরছে, তারা শহীদ হচ্ছে, কিন্তু আপনারা নমনীয় হচ্ছেন না। এর দায় কেউ স্বীকার করছে না। এর দায় সম্পূর্ণভাবেই রাষ্ট্রের, সরকারের।’

আরও পড়ুন

আজ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জড়ো হন নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর ব্যানারে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা। তাঁদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে চোখে–মুখে লাল কাপড় বেঁধে সংহতি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে সেখানে থেকে তাঁরা মৌন মিছিল বের করেন। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে পুরোনো ফজিলাতুন্নেসা হল–সংলগ্ন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে নবনির্মিত ছাত্র-জনতা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে যায়। সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে পুনরায় মিছিল একই পথে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসে শেষে হয়। এরপর সেখানে সমাবেশ করেন তাঁরা।

সমাবেশে দেশব্যাপী কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা, তাঁদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও আটকের ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে ‘মিথ্যা মামলায়’ রিমান্ড মঞ্জুর করার ঘটনার নিন্দা জানানো হয়।

সংখ্যা কোনো বিষয় নয়, যখন একটি শিশুর লাশ পড়ে যায়, তখন সব সচেতন মানুষ একত্র হয়ে যায়।
মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘গোটা রাষ্ট্রই আজ কারাগারে পরিণত হয়েছে। দুঃশাসন এবং স্বৈরাচার—এই দুই মনমানসিকতার দুঃশাসক যখন রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় থাকে, তখন তার পরিপূর্ণ নকশা ও বাস্তবায়নের চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা যখন তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, তখন তাদের প্রতিরোধ করতে রাষ্ট্রের বাহিনী, রাষ্ট্রের নানান যন্ত্র ও তাদের মদদপুষ্ট সংগঠনসমূহ শিক্ষার্থীদের আহত করেছে, আঘাত করেছে। এখন আমরা শুনতে পাচ্ছি ও দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষার্থীদের নির্বিচার আটক করা হচ্ছে, জেলে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের দ্রুত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সারা দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আটক করা হলে, হেনস্তা বা তাঁদের ওপর হামলা হলে আমাদের আর বসে থাকার সুযোগ হবে না।’

আরও পড়ুন

সংখ্যা কোনো বিষয় নয়, যখন একটি শিশুর লাশ পড়ে যায়, তখন সব সচেতন মানুষ একত্র হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার। তিনি বলেন, ‘আজকে যে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, এগুলোর সমাধান করে নিজেদের দায় স্বীকার করে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে নিজেরাও বাঁচুন, আমাদেরও বাঁচান।’

সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক তৌহিদ সিয়াম বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে গতকাল (সোমবার) শোক ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, যে রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত আন্দোলন চলাকালে শহীদদের তথা যাদের জন্য শোক ঘোষণা করেছে, তাদের সংখ্যা স্পষ্ট করে বলতে পারছে না এবং যে হত্যার জন্য রাষ্ট্র সরাসরি জড়িত, সেই রাষ্ট্রের শোক ছাত্রসমাজ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছে। শহীদ ভাইদের হত্যার বিচার ও ৯ দফা দাবিতে মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছি। দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৃধা মো. শিবলী নোমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. মাসউদ ইমরান প্রমুখ।