নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মিয়ানমারের মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ, এপারে থমথমে অবস্থা
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থেমে নেই গোলাগুলি। আজ শনিবার সকাল সোয়া নয়টা থেকে রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং পাহাড়ে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বেলা দুইটার দিকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত থেমে থেমে ছোড়া হচ্ছিল আর্টিলারি ও মর্টারের গোলা।
গতকাল শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টারের একাধিক গোলা পাহাড়ের পাদদেশের শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে এসে পড়লে মো. ইকবাল নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। আহত হয় এক মেয়েশিশুসহ আশ্রয়শিবিরের আরও পাঁচ রোহিঙ্গা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন দিন চুপচাপ থাকার পর গতকাল সন্ধ্যা থেকে মুহুর্মুহু গুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। থেমে থেমে ভোররাত চারটা পর্যন্ত চলে। এতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়ে লোকজন ঘর থেকে বের না হওয়ায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ঝুঁকি এড়াতে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পাশের কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। আজ বেলা ১১টা থেকে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীরা কুতুপালং উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে পৌঁছে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় অংশ নেয়।
ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (ইনচার্জ) সোহাগ রানা প্রথম আলোকে বলেন, সকালে ঘুমধুম কেন্দ্রের প্রায় ২৫০ এসএসসি পরীক্ষার্থীকে উখিয়ার কুতুপালং কেন্দ্রে পৌঁছানো হয়েছে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আগেভাগে কেন্দ্রে পৌঁছেছে। এই কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৪৯৯ জন। মিয়ানমার সীমান্তে কারা গোলাগুলি করছে, গোলা এসে কোথায় পড়ছে, সেখানে (সীমান্তে) গিয়ে এসব তথ্য সংগ্রহের সুযোগ পুলিশের নেই। সীমান্ত এলাকায় কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে বিজিবি তৎপর রয়েছে।
সকাল থেকে নানাভাবে চেষ্টা করেও গণমাধ্যমকর্মীরা তুমব্রু সীমান্তের দিকে যেতে পারেননি। পথেই বিজিবি চেকপোস্টে তাঁদের থামিয়ে দেওয়া হয়। সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বিজিবি সদস্যরা কিছুই বলছেন না।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, গোলাগুলি হচ্ছে একতরফাভাবে। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে গুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ঘটনা পরিকল্পিত মনে হচ্ছে। কারণ, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বহু আগে থেকেই চাইছে আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের অন্যত্র (বাংলাদেশে) সরিয়ে দিতে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এই আশ্রয়শিবির ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয়। কারণ, এই শিবিরের পেছনে রাখাইন রাজ্যেই রোহিঙ্গাদের বাড়ি।
তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ (৫০) টানা ১০ বছর মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্য ছিলেন। তাঁর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মেদিপাড়ায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে মিয়ানমারের পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের পাশাপাশি থেমে থেমে মর্টারের গোলা ছোড়া হচ্ছিল। গোলাগুলি চলে ভোররাত চারটা পর্যন্ত। বেশ কিছু গুলি ও মর্টারের গোলা শূন্যরেখার বিভিন্ন জায়গায় এসে পড়েছে। রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে বিকট শব্দে একটি মর্টারের গোলা আশ্রয়শিবিরের উত্তর পাশে কনোরপাড়া খালের পাশে এসে পড়ে। তাতে তিন পরিবারের ছয় রোহিঙ্গা আহত হয়। পরে ইকবাল নামের এক রোহিঙ্গা কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ও পরে মিয়ানমারের একটি জেট ফাইটার বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তরে তুমব্রু এলাকা চক্কর দিয়ে রাখাইন রাজ্যের দিকে ফিরে গেছে।
দিল মোহাম্মদ আরও বলেন, মাঝখানে কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আজ সকাল সোয়া নয়টা থেকে পুনরায় শুরু হয়েছে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ। থেমে থেমে ছোড়া হচ্ছে আর্টিলারি ও মর্টারের গোলা। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, গোলাগুলি হচ্ছে একতরফাভাবে। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে গুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ঘটনা পরিকল্পিত মনে হচ্ছে। কারণ, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বহু আগে থেকেই চাইছে আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের অন্যত্র (বাংলাদেশে) সরিয়ে দিতে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এই আশ্রয়শিবির ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয়। কারণ, এই শিবিরের পেছনে রাখাইন রাজ্যেই রোহিঙ্গাদের বাড়ি। বাড়ি ফিরতে হলে কিংবা বাড়ির ফেরার সুযোগ সৃষ্টি হলে রোহিঙ্গারা এই আশ্রয়শিবির থেকেই হাঁটাপথে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছুক।
তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পাঁচ বছর ধরে আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে বসবাস করছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবির ঘেঁষে (পেছনে) মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া ও রাখাইন রাজ্যের একাধিক পাহাড়। পাহাড়ের ওপর দেশটির বিজিপির একাধিক তল্লাশিচৌকি। আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের ত্রাণসহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)। ১৫ দিন পরপর সেখানে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়।
তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা ও ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারের গোলায় আহত পাঁচ রোহিঙ্গা বর্তমানে উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সাদিয়া নামের এক শিশুকে রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গা কিশোর ইকবালের মরদেহ দুপুর ১২টা পর্যন্ত শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে আনা হয়নি। ব্যাপক গোলাগুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ঘটনায় সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। থমথমে পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে।
শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে ৫ নম্বর শেডের মাঝি মো. ছাদেক বলেন, গতকাল রাতে মিয়ানমারের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টারের গোলাটি আশ্রয়শিবিরের উত্তর পাশের কোনারপাড়া খালের ভেতরের অংশে পড়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের বসতি কম। গোলাটি আশ্রয়শিবিরের ২০ থেকে ৩০ গজ ভেতরে পড়লে হতাহত মানুষের সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। এ ছাড়া শূন্যরেখার বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি গোলা এসে পড়েছে। কাঁটাতারের পাশে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের টহল বাড়ানো হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যে মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ এবং এপারে গোলা এসে পড়ার ঘটনায় আতঙ্কে আছেন ঘুমধুমের কয়েক শ কৃষক। ১০ থেকে ১৫ দিন ধরে তাঁরা মাঠে নামতে পারছেন না। মিয়ানমার সীমান্তে অন্তত ৭০০ একর জমিতে বাংলাদেশি কৃষকেরা ধান ও শাকসবজির চাষ করেন। গতকাল বিকেলে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখার ৩৫ নম্বর পিলারের কাছাকাছি জায়গায় গরু আনতে গেলে স্থলমাইন বিস্ফোরণে অথোয়াইং তঞ্চঙ্গ্যা (২২) নামের বাংলাদেশি এক তরুণের বাঁ পায়ের গোড়ালি উড়ে যায়। ঘুমধুমের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের হেডম্যানপাড়ার বাসিন্দা ওই তরুণের চিকিৎসা চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শূন্যরেখায় আরও মাইন পোঁতা থাকতে পারে—এমন শঙ্কায় মাঠে যাচ্ছেন না কৃষকেরা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি গুলি তুমব্রু বাজারের পাশে কোনারপাড়ার কৃষক শাহজাহানের বাড়ির আঙিনায় এসে পড়ে। বাড়ির পাশেই শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। এর আগেও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি গোলা এসে পড়ার ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঢাকা।
ঘুমধুম ইউপির চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর গোলাগুলির ঘটনায় ঘুমধুমের মানুষ আতঙ্কে আছেন। তাঁরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। সীমান্তে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।