হুইলচেয়ার পেয়ে দুই বছর পর বাড়ির বাইরে এলেন মনিরুল

মা–বার সঙ্গে মনিরুল ইসলাম। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বাঘডাঙ্গা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

গাছ থেকে পড়ে পিঠের হাড় ভেঙে যাওয়ায় দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেন মনিরুল ইসলাম (২২)। দুই দফা অস্ত্রোপচারের পর কোনোরকমে বেঁচে আছেন, কিন্তু তিনি দরিদ্র পরিবারের সদস্য। চিকিৎসার ব্যয় আর বইতে পারেনি পরিবার। বেঁচে থাকলেও বিছানায় পড়েছিলেন তিনি। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে কাটত তাঁর দিন-রাত।

তিন বছর পর এক ব্যক্তির তাঁকে গত রোববার একটি হুইলচেয়ার উপহার দিয়েছেন। সেই হুইলচেয়ারে চেপে দীর্ঘদিন পর ঘরের বাইরে বের হতে পেরেছেন। এখন তিনি ওই চেয়ারে বসেই অন্যদের সহযোগিতায় বাড়ির মধ্যে ও আশপাশে ঘোরাফেরা করছেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলছেন, রাস্তা দিয়ে যাওয়া গ্রামের মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন।

মনিরুল ইসলাম ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বাঘডাঙ্গা গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিনের ছেলে। বাড়িতে আছে আরিফা খাতুন নামের ১১ বছর বয়সের ছোট বোন আছে আর মা শানু বেগম গৃহিণী। বাবা, মা আর ছোট বোনকে নিয়ে মনিরুলের সংসার। আরও দুই ভাই থাকলেও তাঁরা আলাদা থাকেন।

মনিরুল বলেন, তিনি টাইলস মিস্ত্রির কাজ করতেন। বাবা জালাল উদ্দিন অসুস্থ, কাজ করতে পারেন না। মাঠে মাত্র ৭ শতক জমি আছে আর ৫ শতক জমির ওপর বেড়ার ঘর। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। সংসারে হাল ধরতে টাইলস মিস্ত্রির সঙ্গে কাজে যান। এই কাজ করেই বাবা-মা ও ছোট বোনটির মুখের খাবার জুটিয়েছেন।

মনিরুল জানান, ২০২১ সালের ৭ মার্চ বাড়ির পাশে একটি গাছের ডাল কাটতে উঠেছিলেন। হঠাৎ করে গাছ থেকে পড়ে যান। এরপর তাঁর পিঠের হাড় ভেঙে যায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় দুই মাস চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। করা হয় দুটি অস্ত্রোপচার। তবে তাঁর শরীরের নিচের অংশের শক্তি হারিয়ে গেছে।

ঢাকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দ্রুত উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে তিনি আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন। তাঁরা ভারতের চেন্নাই যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেখানে চিকিৎসা করতে ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন, যা জোগাড় করতে না পারায় চিকিৎসা হচ্ছে না।

বাবা জালাল উদ্দিন জানান, এখন পর্যন্ত ছেলের চিকিৎসায় তাঁর ৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, যার বেশির ভাগই আত্মীয়স্বজন দিয়েছেন। মাঠের ৭ শতক জমি ৫০ হাজার টাকায় ইজারা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন। সবই খরচ হয়ে গেছে। এখন তাঁর পক্ষে আর কোনো টাকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। সংসার চালাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে কাজে যাচ্ছেন। এভাবে মাসে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আয় করছেন, যা দিয়ে স্ত্রী-কন্যা আর অসুস্থ ছেলে নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছেন। ছেলে একটি হুইলচেয়ারের জন্য দুই বছর ঘর থেকে বের হতে পারেনি। গোসল, বাথরুম সবই বিছানায় হয়েছে। গত রোববার একজন দানশীল ব্যক্তি একটি হুইলচেয়ার দেওয়ার পর বাইরে বের হচ্ছে।  

মনিরুল বলেন, দুই বছর পর বাড়ির বাইরে বের হয়েছেন। যে পথ দিয়ে প্রতিদিন বাইরে কাজে যেতেন, আবার বাড়ি ফিরে আসতেন, সে পথ আবার দেখতে পেয়েছেন। রোদ পোহাচ্ছেন। দুই বছর অসম্ভব কষ্ট করেছেন। তিনি আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে চান। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। এ জন্য তিনি সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

জামাল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আতাউর রহমান জানান, মনিরুল ছেলেটি তাঁর প্রতিবেশী। হঠাৎ তাঁর জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে। তাঁর অবস্থা দেখে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে কিছু টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো তাঁর চিকিৎসায় অনেক টাকার প্রয়োজন। সমাজের মানুষ এগিয়ে এলে ছেলেটি আবার দাঁড়াতে পারবেন, বেঁচে যাবে একটি সংসার।