‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে’র পরিচয়ে আসামি ছাড়াতে ডিআইজি অফিসে তদবির, ভিডিও ভাইরাল
পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা পরিচয়ে এক দল তরুণের হাঙ্গামার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ব্যবহার করে ওই তরুণেরা শিক্ষার্থী হত্যা মামলার আসামিকে ছাড়াতে চাপ সৃষ্টি করেন। তাঁরা ডিআইজি অফিস ছাড়াও বিআরটিসি অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ‘অপতৎপরতা’ চালাচ্ছিলেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ৬ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘটনাটি ছিল গত ২৮ ডিসেম্বর দুপুরের। ভিডিওতে দেখা যায়, একদল তরুণ স্লোগান দিতে থাকেন, ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। ১৫-২০ জনের একটি দল দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ময়মনসিংহ রেঞ্জ ডিআইজি আশরাফুর রহমানের কক্ষে প্রবেশ করেন।
ভিডিওতে ডিআইজিকে উদ্দেশ করে ওই শিক্ষার্থীদের বলতে শোনা যায়, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ময়মনসিংহে নিহত রেদোয়ান হোসেন সাগর হত্যা মামলার আসামিরা কেন ঘুরে বেড়াচ্ছে? গৌরীপুরে আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালেও কেন তাদের গ্রেপ্তার হয়নি? আপনি (ডিআইজি) প্রতি সপ্তাহে স্টেশন লিভ নিয়ে নিজের উপজেলায় গিয়ে নির্বাচনী কাজকর্ম করেন। তারাকান্দার ওসি আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। পুলিশ একটি দলকে সমর্থন করে কাজ করছে। আপনারা (পুলিশ) এমনভাবে কাজ করছেন, টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের না ধরে আপনারা ধরতাছেন কারে, জাসদের মতো ছোট দলের লোককে।’ এ সময় পুলিশের একজন ভিডিও করতে শুরু করলে কয়েক তরুণ চিৎকার করে বলেন, ‘একদম ভিডিও করবেন না।’ ডিআইজি আশরাফুর রহমানের সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীদের বাদানুবাদ হয়।
পুলিশ জানায়, ২৭ ডিসেম্বর রাতে মহানগর জাসদের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনে সাবেক কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম ওরফে মিন্টুকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে সদর থানায় হস্তান্তর করে। ১৯ জুলাই নগরের মিন্টু কলেজ এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কলেজছাত্র রেদোয়ান হোসেন সাগর নিহত হন। এ ঘটনায় তিনটি হত্যা মামলা হয়। এর মধ্যে গত ৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দের করা মামলায় শফিকুল ইসলাম এজাহারভুক্ত আসামি।
ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি আশরাফুর রহমান বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয় ব্যবহার করে দলটি এসে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক কাউন্সিলর মিন্টুকে ছেড়ে দিতে বলে। সেই সঙ্গে বিগত সময়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো কাউন্সিলরকে যেন গ্রেপ্তার না করা হয়, সে দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা যে আচরণ নিয়ে আমার কার্যালয়ে আসে, তা অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চেতনাবিরোধী। যে ঘটনাটি ঘটেছে, বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন মহলকে জানানো হয়েছে। আমরা বিষয়গুলো দেখছি এবং এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে।’
ডিআইজি আশরাফুর আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে সরকারকে ফেল করানোর জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী মহল যেন এ ধরনের কাজ না করতে পারে। আমার কার্যালয়ের ঘটনার পর সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে খবর পাচ্ছি, এই গ্রুপ বিভিন্ন অফিসে অফিসে ঘুরছে। সরকারি কাজে বাধা দেয় এবং অন্য অনৈতিক বিষয়ও রয়েছে। বিষয়গুলো আমরা তদন্ত করছি। বিষয়গুলো নিয়ে কেউ মামলা দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে যারা চাঁদাবাজি করে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ডিআইজি অফিসে যাওয়া দলটিতে নেতৃত্ব দেন সায়েবে রাকাত ও আল নূর আয়াশ। আল নূর আয়াশ আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দেন। কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, এর আগে ২৭ ডিসেম্বর রাতে শফিকুল ইসলাম গ্রেপ্তারের পর কোতোয়ালি থানায় গিয়ে তদবির চালান সায়েবে রাকাত ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া আরেক তরুণ। এ ছাড়া ছিলেন ছাত্রশিবিরের কর্মী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহের সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া মাহাদী হাসান তারেক, মেহেদি হাসান সিয়াম, ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী সাকিব হাসান রিমন, অলি উল্লাহ, মাজাহারুল ইসলাম রানা, রাকিবুল ইসলাম, সাগর হত্যা মামলার সাক্ষী ও সাবেক কাউন্সিলর মিন্টুর নাতি নিহাল প্রমুখ।
ডিআইজি কার্যালয়ে হাঙ্গামায় জড়িত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে ঘটনার পর কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি।
এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর নগরের চরকালিবাড়ী এলাকায় ময়মনসিংহে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসের ডিপো ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটি দল মহড়া দিয়ে হট্টগোল করে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি জিডি করা হয় বিআরটিসির পক্ষ থেকে এমনটি জানিয়েছে পুলিশ।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, ‘গত ১০ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে আল নূর আয়াশ নামে একজন এসে একজন ঠিকাদারের পক্ষে অনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে। পরে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়।’
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘সাবেক কাউন্সিলরকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কি না, সে বিষয়ে থানায় জানতে গিয়েছিলাম। অহেতুক যেন কেউ হয়রানির শিকার না হন, সেটি ছিল আমাদের কথা।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার নাম ভাঙিয়ে অনেকে তদবির করেছে। বিভিন্ন অফিসের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে, যে বিষয়গুলো আমার অজানা। আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ সুবিধা নিতে গেলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি প্রশাসনকে। ডিআইজি অফিসে যে কাজ হয়েছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। যদি কেউ অপরাধ করে, তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে।’
শিক্ষার্থী সায়েবে রাকাতের মুঠোফোনে ফোন করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ময়মনসিংহের সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া আল নূর আয়াশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ময়মনসিংহে আন্দোলনে শহীদ রেদোয়ান হোসেন সাগর হত্যার আসামিকে পুলিশ ধরছিল না। আমরা জানতে পারি, পুলিশ আসামি ধরতে যাওয়ার আগেই মেসেজ দিয়ে দেয়, তারা যাচ্ছে। আসামিরা যেন সরে যায়। আন্দোলনে পুলিশ গুলি করলেও একজন পুলিশকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। শুধু আওয়ামী লীগের দোসররাই ছিল না এখানে, পুলিশও ছিল। কেন তাঁদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না, এসব বিষয় নিয়েই ডিআইজির কাছে যাওয়া হয়। কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম মিন্টুকে ছাড়ার জন্য আমরা বলিনি। শুধু বলেছি সাধারণ মানুষকে যেন হয়রানি না করা হয়।’
বিভিন্ন সরকারি অফিসে গিয়ে ‘অপতৎপরতা’ চালানোর অভিযোগ সম্পর্কে আল নূর আয়াশ বলেন, ‘এগুলো যারা করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ডিআইজি কার্যালয়ে আমরা গিয়েছিলাম এটি সেন্ট্রাল নির্দেশেই।’
তবে ডিআইজি অফিসে যাওয়া দলটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ নন বলে দাবি করেছেন ময়মনসিংহে আন্দোলনের শুরু থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়ক গোকূল সূত্রধর মানিক। তিনি বলেন, ‘যা ইচ্ছা তা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ব্যবহার করবে এটি দুঃখজনক। ডিআইজি অফিসে যারা গিয়েছিল, সেখানে আমাদের কেউ ছিল না। যে ঘটনাটি ঘটেছে এটি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। এ ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ব্যবহার করায় আমরা লজ্জিত। ৫ আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ব্যবহার করে কেউ বিভিন্ন অফিসের চাঁদাবাজি করছে এবং হুমকি-ধমকি দিচ্ছে শুনেছি। আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমরা যারা জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছি, তাঁদের কেউ এ ধরনের কাজে জড়িত না। প্রশাসনসহ সবার কাছে আমাদের আবেদন থাকবে, এদের বিরুদ্ধে যেন সঠিক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
এ ঘটনায় সর্বশেষ আইনি অগ্রগতি বিষয়ে ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি আশরাফুর রহমান আজ দুপুরে বলেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ঘটনার পেছনে ইন্ধনদাতা ও অর্থদাতা রয়েছে। এ ধরনের সমন্বয়ক বা ছাত্র আমাদের সমাজের জন্য প্রয়োজন নেই।’