সিলেট শহরতলীতে অবস্থিত লাক্কাতুরা চা-বাগান। তিন মাস ধরে বাগানটির ৫৬০ জন চা-শ্রমিক বেতন পাচ্ছেন না। তাঁদেরই একজন অরুণ মুদি (৩৪)। গতকাল শনিবার বিকেলে ক্ষোভ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন মাস ধরি বেতন বন্ধ। পরিবার নিয়া বড় অভাবে আছি। এক বেলা খাইলে দুই বেলা উপাস থাকি। সংসার আর চলতাছে না।’
লাক্কাতুরা ছাড়াও তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ রয়েছে সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) ১২টি চা-বাগানের শ্রমিকদের। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এ অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। এরপর বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন চা-শ্রমিকেরা।
যোগাযোগ করলে এনটিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার পর থেকেই এমন অবস্থা চলছে। আসলে ফান্ডের অভাবে চা-শ্রমিকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। তবে সরকারের সহযোগিতায় অচলাবস্থা নিরসনের চেষ্টা চলছে। দ্রুতই এর সমাধান হবে বলে আশা করছেন তিনি।
গতকাল বিকেলে লাক্কাতুরা চা-বাগানে গেলে চা-শ্রমিকদের মধ্যে খাবারের জন্য হাহাকার দেখা যায়। তাঁরা বলেন, একেকজন শ্রমিক দৈনিক মাত্র ১৭০ টাকা মজুরি পান। এর মধ্যে তিন মাস ধরে তাঁরা মজুরি পাচ্ছেন না। বাগান কর্তৃপক্ষ সপ্তাহে সামান্য পরিমাণে আটা দিচ্ছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন দুই দফায় কিছু চাল দিয়েছে। দ্রুত এ অচলাবস্থা নিরসনের দাবি জানিয়েছেন চা-শ্রমিকেরা।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, সিলেট জেলায় এনটিসির অধীন তিনটি বাগান আছে। এগুলো হচ্ছে লাক্কাতুরা, কেওয়াছড়া ও দলদলি চা-বাগান। এসব বাগানে ১ হাজার ১৮০ জন শ্রমিক আছেন। এ ছাড়া বিভাগের চা-বাগানগুলোতে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছেন। তাঁদের ওপর নির্ভরশীল আছেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। সবাই এখন খাদ্যসংকটে ভুগছেন।
লাক্কাতুরা চা-বাগানের শ্রমিক অনিতা মুদির (৩২) স্বামী ২০২০ সালে মারা যান। দুই ছেলে, এক মেয়ে ও শ্বাশুড়িকে নিয়ে তাঁর সংসার। পরিবারে দেবর ও দুই জা আছেন। অনিতা বলেন, ‘কুনু রুজি-রোজগার নাই। দেবর টুকিটাকি কাজ করে কুনুরকমে সংসার চালাইতাছে। বাইচ্ছার চাহিদা দিতে পারতাছি না।’
চল্লিশোর্ধ্ব চা-শ্রমিক সেবা গোয়ালা বলেন, তাঁর পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়। বিকল্প পেশা না থাকায় বেতন না পেয়ে তাঁরা খুব কষ্টে আছেন। বাগান থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে কোনোরকমে ক্ষুধা নিবারণ করছেন।
ঘরে খাবার নেই উল্লেখ করে স্মৃতি গোয়ালা নামের একজন বলেন, সপ্তাহে বাগান কর্তৃপক্ষ তিন কেজি আটা দেয়। তা দিয়ে খাবারের চাহিদা মেটাচ্ছেন তাঁরা। স্বামী বাগান থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে বিক্রি করতে পারলেই একদলা ভাত মুখে দিতে পারছেন। নতুবা আটা খেয়েই কোনোরকমে চলতে হয়।
এদিকে সিলেটের লাক্কাতুরা, কেওয়াছড়া ও দলদলি চা-বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ এবং চা-বাগান রক্ষা করার দাবিতে সংহতি সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশন। গতকাল বেলা তিনটায় সিলেটের লাক্কাতুরা এলাকায় এ সমাবেশ হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশন সিলেট জেলার সভাপতি বীরেন সিং। বক্তব্য দেন সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরী, বাংলাদেশ কর্মচারী ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক উজ্জল রায়, সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আবদুল করিম চৌধুরী (কিম), আইনজীবী হুমায়ূন রশীদ সোয়েব, সাংবাদিক দেবাশীষ দেবু, চা-শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক হৃদেশ মুদি প্রমুখ।