মা-বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে চিকিৎসক হবে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে মেধাবৃত্তি পেয়েছিল ছেলেটি। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলের আশায় ছিল সবাই। তবে সে পেয়েছে জিপিএ-৪.৯৮। কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় পৃথিবী থেকেই চিরতরে চলে গেছে ছেলেটি।
গত রোববার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ওই দিন দুপুরে নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ভাড়া বাসা থেকে ছেলেটির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। সে সৈয়দপুরের একটি বিদ্যালয়ে পড়ত। তার মা-বাবা দুজনই বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুজনের কর্মস্থল রংপুরের বদরগঞ্জে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি ওই উপজেলায়। এ ছাড়া এসএসসিতে অনুত্তীর্ণ বদরগঞ্জের আরও এক ছাত্রী কীটনাশক পান করে মারা গেছে।
শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দুজন এসএসসি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি। তারা অভিভাবকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এ জন্য তাদের কটু কথাও শুনতে হয়েছে। মানসিক চাপ ও হতাশায় তারা আত্মহত্যা করেছে।
ওই দুই শিক্ষার্থী মৃত্যুর পর পরিবারে মাতম চলছে। গতকাল সোমবার দুপুরে ওই শিক্ষক দম্পতির গ্রামের বাড়িতে ঢোকার আগেই কান্নার শব্দ পাওয়া যায়। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, উঠানে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন ওই দম্পতি। তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বজনেরা। ছেলেটির মা আহাজারি করে বলছিলেন, ‘আমার ছেলেটা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, রোজা রাখত। টিফিনে না খেয়ে টাকা জমিয়ে এবং বৃত্তির টাকা তুলে অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করত। সে স্বপ্ন দেখত ডাক্তার হওয়ার। আশপাশের মানুষ বলত, “মাস্টারনি একটা রত্ন জন্ম দিয়েছে।” কিন্তু আমার রত্ন কোথায় হারিয়ে গেল? এখন কাকে নিয়ে বেঁচে থাকব?’
ছেলেটির মা কিছুটা শান্ত হয়ে বলেন, ‘ছেলেটি যেন পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে পারে, সেই লক্ষ্যে আমরা বদরগঞ্জের বাড়ি ছেড়ে ১৪ কিলোমিটার দূরে নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। আমরা দুজন (স্বামী-স্ত্রী) বদরগঞ্জে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছেলেকে ঠিকমতো সময় দিতে পারতাম না। তবে রাতের খাবারটা আমি নিজ হাতে তাকে খাওয়ায়ে দিলাম।’
এ সময় বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বাবা, তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ। আর কোনো দিন দেখা হবে না। আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো।’
ছেলে যে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। সে মেধাবী শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ না পাওয়ায় আমরা অবাক হয়েছি। আমার বিশ্বাস, পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করলে সে জিপিএ-৫ পাবে।’
এদিকে গতকাল বিকেলে আত্মহননকারী ছাত্রীটির বাড়িতে গিয়ে শোনা যায় কান্নার রোল। তাকে দাফনের প্রস্তুতি চলছিল। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সহপাঠী ও প্রতিবেশীরা ভিড় করেছেন। কবরস্থানে লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর মা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
ছাত্রীটির বাবার বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে মেয়েটাকে পড়াতাম। চাইতাম, মেয়েটা যেন ডাক্তার হয়। যখন শুনলাম মেয়েটা পরীক্ষায় ফেল করেছে, তখন মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। অনেকে অনেক কটু কথা বলেছে। এসব শুনে মেয়েটা হতাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা তাকে কিছু বলিনি।’
ছাত্রীটির বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘মেয়েটির আত্মহত্যার কথা শুনে আমরা সবাই ছুটে এসেছি। সে শুধু “বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়” বিষয়ে ফেল করেছে। বোর্ডের ফলাফলে ভুলও থাকতে পারে। কারণ, সে ফেল করার মতো ছাত্রী নয়। তার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমাদেরও কাঁদাচ্ছে। শুনেছি, ফেল করায় মা–বাবা তাকে গালমন্দ করেছেন।’
শিক্ষার্থীদের আত্মহননের বিষয়ে বদরগঞ্জ মহিলা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক আবু হাসেম বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে সন্তানদের নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা চলছে। তাঁরা সন্তানদের পড়াশোনায় সক্ষমতার অতিরিক্ত প্রত্যাশা করে ভীষণ মানসিক চাপে রাখছেন। কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ সন্তানদের অনেকে শারীরিক নির্যাতন, কটূক্তি ও অবহেলা করেন। এ কারণে ভরসার জায়গা না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
অভিভাবকদের প্রতি আবু হাসেমের পরামর্শ, সব শিক্ষার্থীর সক্ষমতা এক রকম নয়। পরীক্ষায় ফেল করা কিংবা কোনো কাজে ব্যর্থতা মানে জীবন শেষ হওয়া নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জোগানো দরকার। অবহেলা না করে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিতে হবে। তাহলে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়ানোর উৎসাহ পাবে।