কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক সমুদ্র উপকূলে ডুবন্ত ট্রলার থেকে উদ্ধার করা অর্ধগলিত ১০টি লাশের মধ্যে ছয়জনের বাড়ি মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ি গ্রামে।
ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সোমবার রাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে মহেশখালীতে আনা হয় চারজনের লাশ। তাঁদের মধ্যে শাপলাপুরের মিঠাছড়ি গ্রামের তিনজন হলেন জাফর আলমের ছেলে সওকত উল্লাহ (১৮), মুসা আলীর ছেলে ওসমান গণি (১৭) ও মোহাম্মদ হোসাইনের ছেলে নুরুল কবির (২৮)। অপরজন হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়ার রফিক মিয়ার ছেলে সামশুল আলম (২৩)।
এ ঘটনায় মিঠাছড়ি গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (১৮), সাহাব মিয়ার ছেলে সাইফুল্লাহ (২৩) এবং মোহাম্মদ আলীর ছেলে পারভেজ মোশাররফ (১৪) নিহত হলেও তাঁদের লাশ এখনো হস্তান্তর করা হয়নি।
আজ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মিঠাছড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিহত ওসমান গণির বাড়িতে অনেক মানুষের জটলা। ঘরের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছেন ওসমানের মা জুহুরা বেগম (৪২)। তাঁর হাতে দুইজনের ছবি। একটি ছেলে ওসমান গণির, অন্যটি জামাতা সওকত উল্লাহর।
ছবি দুটি বুকে নিয়ে বিলাপ করতে করতে জুহুরা বলেন, ওসমান জীবনে কোনো দিন সাগরে মাছ ধরতে নামেননি। প্রতিবেশী নুরুল কবির তাঁর ছেলে এবং মেয়ের জামাইকে সাগরে নামিয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চান তিনি।
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন ওসমান গণির বড় বোন জেসমিন আক্তার (২০)। তিনি বলেন, পচে ভাইয়ের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। একনজর দেখাও হয়নি। রাতে যখন লাশ আনা হলো, তখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন ওসমান গণি। কাজ করতেন পানের বরজে। ওই বাড়ির দক্ষিণে ওসমানের বোনের জামাই সওকত উল্লাহর বাড়ি। এ ঘটনায় নিহত নুরুল কবির, পারভেজ মোশারফ, সাইফুল্লাহ ও সাইফুল ইসলামের বাড়িও আশপাশেই। একসঙ্গে ছয়জনকে হারানোর বেদনা ভুলতে পারছেন না এলাকাবাসী।
স্থানীয় গ্রাম পুলিশ জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, মহেশখালীর সাতজনের মধ্যে সামশুল ও নুরুল কবির ছাড়া বাকিরা কোনো দিন সাগরে নামেননি। তাঁদের কেন সাগরে নামানো হয়েছিল, এ বিষয়ে এলাকার মানুষ কিছুই জানেন না। নুরুল কবির এবং সামশুল আলম মারা যাওয়ায় রহস্যের জট খুলছে না।
স্থানীয় শাপলাপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সেলিম উল্লাহ বলেন, নুরুল কবির ও ট্রলারমালিক সামশুল আলমের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, অস্ত্র, মাদক ও ডাকাতির প্রস্তুতির পৃথক চারটি মামলা রয়েছে।
পুলিশ জানায়, গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান ও পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলামের উপস্থিতিতে সামশুল, তারেক, সওকত, শাহজাহান, ওসমান ও নুরুল কবিরের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অপর চারটি লাশ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
এদিকে গতকাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা হয় ওসমান গণি, নুরুল কবির ও সওকত উল্লাহর। এতে হাজারো মানুষ অংশ নেন। জানাজায় ইমামতি করে নিহত ওসমানের চাচা মৌলানা নুরুল মোস্তফা। জানাজা পড়ানোর আগে তিনি বলেন, পাঁচ দিন আগে লাশগুলো পেলে অন্তত চেহারাটা একনজর দেখা যেত। এখন সেই সুযোগও নেই। পচে সবার চেহারা ও শরীর বিকৃত হয়ে গেছে।
পরে তিনজনের লাশ স্থানীয় মিঠাছড়ি পুরাতন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ট্রলারটির মালিক সামশুল আলমের লাশ গতকাল মধ্যরাতে দাফন করা হয় হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলাপাড়া কবরস্থানে।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানান, গভীর সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া ট্রলারটি আরেকটি মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়ে। ওই ট্রলারের জেলেরা রশি দিয়ে ডুবন্ত ট্রলারটি টেনে মহেশখালীর সোনাদিয়া চ্যানেলে নিয়ে আসেন। গত রোববার বেলা দেড়টার দিকে ডুবন্ত ট্রলারটি কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক (বিমানবন্দরের পশ্চিমে) চ্যানেলে পৌঁছালে মৃত ব্যক্তির হাত-পা ভেসে উঠতে দেখা যায়। এতে ভয় পেয়ে টেনে আনা ট্রলারের জেলেরা ডুবন্ত ট্রলারটি রেখে পালিয়ে যান। খবর পেয়ে ওই দিনই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেন।
ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত দাবি করে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ট্রলারের বরফ রাখার কক্ষ থেকে ওই ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে তিনজনের হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। কয়েকজনের শরীরে জাল প্যাঁচানো ছিল। একটি লাশের গলা থেকে মাথা ছিল বিচ্ছিন্ন। আরেকটি লাশের হাত বিচ্ছিন্ন পাওয়া গেছে। লাশগুলো ট্রলারের যে কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই কক্ষের ঢাকনাও পেরেক দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া ট্রলারের জাল ও ইঞ্জিন রয়ে গেছে।