ফাঁস হওয়া ঘুষ লেনদেনের কথোপকথন চারঘাটের সেই ওসির, তদন্ত প্রতিবেদন ডিআইজির কাছে
রাজশাহীর চারঘাট মডেল থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুল আলমের ফাঁস হওয়া আলোচিত ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ডটি তাঁরই। পুলিশের তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে। ওই অডিওতে এক নারীর কাছে সাত লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন ওসি মাহবুবুল আলম। যদিও অডিওটি ফাঁস হওয়ার পর ‘এডিটেড’ (সম্পাদিত) বলে দাবি করেছিলেন তিনি।
রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সোমবার তিনি তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছেন। অভিযোগকারী ওসির বক্তব্য রেকর্ড করেছিলেন। এটা ওসির কথোপকথন ছিল। এখন এটা তিনি রাজশাহীর ডিআইজিকে (উপমহাপরিদর্শক) দিয়েছেন। তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠাবেন। তারা পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ওসি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন সাহারা খাতুন (২৮) নামের এক নারী। এর সঙ্গে ঘুষ চাওয়ার ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের কথোপকথনের একটি রেকর্ডও সংযুক্ত করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকে অডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ওসি মাহবুবুলকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।
এ ঘটনায় ১৭ সেপ্টেম্বর তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দেন পুলিশ সুপার। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। পরে কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরও পাঁচ দিনের সময় দেন পুলিশ সুপার।
তদন্ত কমিটি ৪০ জনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এর মধ্যে অভিযোগকারী সাহারা খাতুন, ওসি মাহবুবুল, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রুবেল অন্যতম। সাক্ষাৎকারে অভিযোগকারী নারী পুরো ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের অডিও রেকর্ড পুলিশের কাছে জমা দেন।
ফাঁস হওয়া ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের অডিওর একটি অংশে মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘এক মন্ত্রী বাদে কারও কথা শুনতে এখানে আসি নাই।...এই লোকটা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে সম্মান করি। মন্ত্রী মানেই রাষ্ট্র। আর মন্ত্রী অত্যন্ত ভদ্রলোক মানুষ। আমাকে নিয়ে আসছে সে। আমাকে গাইবান্ধা থেকে নিয়া আসছে। তাহলে আমি যদি খারাপ হই, তাহলে কষ্ট পাবে।’
ওসির কথার মধ্যে চারঘাটের শলুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম সুর মিলিয়ে বলেন, ‘আপনাকে নিয়া আসছে একেবারে নির্বাচনটা পার করে দিবেন...।’ জবাবে ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘তা তোমাদের রিজিকে আছে কি না, আমি জানি না। এখন এই যে নির্বাচন কমিশনার নাটক শুরু করেছে।’
কথোপকথনে রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমকে জড়িয়ে বক্তব্য আসায় এ নিয়ে গণমাধ্যমে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার কোনো নিয়োগে আমি সুপারিশ করি না। যত দূর মনে পড়ে, তিনি যোগদান করেছেন অনেক দিন আগেই। অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার জন্য কয়েক দফা কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত ছিলেন বলে শুনেছি।’
ওই অডিওতে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার স্বামী কিন্তু আমার কম ক্ষতি করে নাই। বহুত ফাঁকি দিয়েছ। কালকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখনো কিন্তু তোমার গায়ে আঁচড় দিইনি। এখন সে রকম সময় নয় যে কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে (পুলিশ সুপার) কথা দিয়ে এসেছি। স্যারের এখন কী কী লাগবে—পাঁচ লাখ টাকা। কী কী জিনিস চাইছে—সাত লাখ টাকা লাগবে। আমি বলেছি, আমি চেষ্টা করব। স্যারকে বলেছি, এখানে মাদক ছাড়া কিছু নেই। ওপেন। তখন আর কথা কয় না। তোমরা পাঁচ লাখ টাকা দিতে পারবা? ধরে ওদের (এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের) চালান দিয়ে দেব। থাকি না থাকি ওদের সাইজ করব। তোমরা বাইরে থেকে ব্যবসা (মাদক ব্যবসা) করবে।’
তদন্ত কমিটির সদস্য ও রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।