সুন্দরবনে চলতি মৌসুমে গোলপাতা আহরণে পদে পদে ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ বাওয়ালিদের। তাঁদের দাবি, বন কর্মকর্তাদের তো বটেই, ডাকাত দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সাংবাদিকদের নামেও ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। গোলপাতা আহরণের জন্য নৌকাপ্রতি সরকারকে যে টাকা রাজস্ব দিতে হয়, ঘুষ দিতে হচ্ছে এর কয়েক গুণ বেশি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাওয়ালিরা লোকসান বাঁচাতে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গোলপাতা নৌকায় করে আনছেন। গোলপাতার আড়ালে আনছেন বিভিন্ন গাছের খণ্ড। এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ছে সুন্দরবন। অনেক বাওয়ালি লোকসানে পড়ে তাঁদের গোলপাতার ব্যবসা বন্ধ করার ঘোষণাও দিয়েছেন।
কয়রা নদীর তীরে বাঁধা নৌকা থেকে গোলপাতা নামানোর ফাঁকে বাওয়ালি খলিলুর রহমান বলেন, ‘যে ভাত খায়, সে ঘুষও খায়। বনে ঢুকলি ফরেস্টারগে ঘুষ দিতিই হবে। না হলি নানান হয়রানি। জরিমানা তো গুনতি হবে। যাঁরা এখন নতুন করি দেশ আরেকবার স্বাধীন করিছে, তাঁরাও টাকা খায়। আগের চাইতে এখন আরও বেশি ঘুষ দিতি হচ্ছে।’
বাওয়ালিদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলার সংগঠক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাওয়ালিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় আমাদের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এমন কোনো কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন–সংশ্লিষ্ট কারও বিরুদ্ধে এমন কোনো কর্মকাণ্ডের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি প্রদানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সমন্বয়কদের নামে যাঁরা চাঁদাবাজি করছেন, তাঁদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
নির্ধারিত রাজস্বের বাইরে বাওয়ালীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান। গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে গাছ কাটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবেও কাঠ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা কাটার মৌসুম শুরু হয় ৩ ফেব্রুয়ারি। শেষ হবে ৩১ মার্চ। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরছেন বাওয়ালিরা। একেকটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। আহরণ করা প্রতি কুইন্টাল গোলপাতার জন্য বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়।
মঙ্গলবার সকালে সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, বাওয়ালিরা নদীর বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে স্তূপ আকারে কেটে আনা গোলপাতা সাজিয়ে রাখছেন। নদীর পাড়ে বাঁধা রয়েছে গোলপাতাবোঝাই বড় বড় নৌকা। এসব নৌকায় ৫০০ মণ গোলপাতা বোঝাইয়ের মাত্রা বেঁধে দেওয়া হলেও একেকটি নৌকায় ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা বোঝাই করা। নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার ঝাঁপির নিচে সুন্দরী, পশুরসহ মূল্যবান গাছের খণ্ড।
কয়েকজন বাওয়ালি বলেন, ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া মৌসুমের প্রথম দফায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরেছেন তাঁরা। তবে এবার ডাকাতের চাঁদা আর সরকারি রাজস্বের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি টাকা দিতে হয়েছে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের। ফরেস্ট স্টেশন থেকে অনুমতি দেওয়ার সময় অতিরিক্ত টাকা বখশিশ দিতে হয়েছে। এরপর কুপে তল্লাশি, ঘের দেওয়া, ঘাটে তল্লাশি, সিটি কাটানো (পারমিট হস্তান্তর), বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সাংবাদিকদের চাঁদা দেওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে আরও ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এ কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠ বোঝাই করতে বাধ্য হয়েছেন।
সুন্দরবন থেকে ফিরে আসা বাওয়ালি আবদুস সালাম বলেন, ‘এ মৌসুমে ফরেস্টারদের ঘুষ ও ডাকাতের চান্দার টাকা দিতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়তি হইছে। এর আগে কোনো মৌসুমে এত টাকা বাড়তি খরচ হয়নি। নৌকার পাশ (অনুমতি) নিতে সরকারের খাতে ১২ হাজার টাকা জমা দিতি হলিও ফরেস্টারদের ঘুষ দিতি হইছে ৩০ হাজার টাকা। এরপরও ডাকাতির টাকা, সমন্বয়ক ও সাংবাদিকের কথা বলেও টাকা আদায় করা হইছে। এবার সব মিলিয়ে আমার নৌকায় ৭০ হাজার টাকা বাড়তি খরচ লাগছে, যা গত বছরের তুলনায় দু–তিন গুণ বেশি।’
৫০০ মণ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি গোলপাতার নৌকায় সাকল্যে সরকারি রাজস্ব আসে ১২ হাজার টাকার মতো। তবে কয়রা উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের বাওয়ালি জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এবার বন কর্মকর্তাদের দেওয়া লাগছে ৪০ হাজার টাকা। অথচ গত বছর দিয়েছিলাম ২২ হাজার টাকা। এ ছাড়া নৌকাপ্রতি ২ হাজার ২০০ টাকা করে দেওয়া লাগছে সমন্বয়কদের। এর ওপর সাংবাদিকদেরও আলাদাভাবে টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া তিন দল ডাকাতকে দিতে হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। ঘুষ দিতে গিয়ে ব্যাপক লোকসানে পড়ার কারণে অনেকেই আর সুন্দরবনের ব্যবসা করবেন না।’
এবার সুন্দরবনে গোলপাতা সংগ্রহে ঘুষের পরিমাণ অনেক বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাওয়ালি ফেডারেশনের সভাপতি মীর কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, আগে গোলপাতা কাটতে গিয়ে ফরেস্টারদের টাকা দিলেই চলত। কিন্তু এখন ডাকাত আর সমন্বয়কদের অনৈতিক চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কেউ আর বনে ঢুকতে চাইবে না।
বাওয়ালিদের এসব অভিযোগ সত্য নয় বলে বলে দাবি করেছেন খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা কুপ (জোন) কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার মাধ্যমে সমন্বয়ক ও সাংবাদিকদের টাকা দেওয়া হয়নি। আমরা অতিরিক্ত টাকাও গ্রহণ করিনি। বাওয়ালিদের কাছে আমার কোনো দাবিদাওয়া নেই। তাঁরা কিছু দিলে ভালো কথা, না দিলেও কোনো দাবি নেই।’
তবে সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়রা প্রেসক্লাবের সভাপতি সদর উদ্দিন আহমেদ জানালেন, সুন্দরবন উপকূলে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করছে কিছু ‘ভুয়া’ সাংবাদিক। এদের কারণে মূলধারার সাংবাদিকদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘শুধু গোলপাতার নৌকাই নয়, সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সুন্দরবনে অবৈধ ব্যবসা করেন কয়েকজন। অনেকে প্রতি মাসে ফরেস্ট স্টেশন থেকে মাসোহারাও নেন। আমরা প্রশাসনকে এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।’
সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি হারুন অর রশীদ বলেন, অনেকেই বলার চেষ্টা করেন গোলপাতা না কাটলে গোলপাতা ঝাড়ের ক্ষতি হয়। এটা ঠিক নয়। আসলে গোলপাতা প্রাকৃতিকভাবেই বনে জন্ম নিয়েছে। এটি না কাটলে বনের কোনো ক্ষতি হয় না। পাশেই নতুন নতুন ঝাড় গজায়। বরং গোলপাতা কাটার আড়ালে সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে সরকারি রাজস্ব ফাঁকিসহ গোলপাতার বন ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মুখে ফেলেছেন অসাধু বন কর্মকর্তারা।